বাহিরানা

সূর্যঘরের টারবাইনে— শুভ্র সরকার— ব্যক্তিগত দেখার মাঝে সমষ্টির যোগাযোগ


শুভ্র সরকারের কবিতায় শব্দ লতার মাঝে থাকা পাতার পরস্পরের নিবিড় যোগাযোগের মতো, স্বাভাবিক নিয়ম মেনে তারা দূরত্বে থাকলেও প্রায়শই হাওয়া এসে তাদের এক করে দেয়। এর ফলে যে গতির সঞ্চার হয়, তাতে গড়ে ওঠে চিত্রকল্প, উপমা আর শেষে একটি সম্পূর্ণ কবিতা। দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখলেও তাঁর প্রথম বই ‘বিষণ্ণ স্নায়ুবন’ প্রকাশিত হয়েছে দুই হাজার বিশ সালে। বইটি দীর্ঘ কবিতার, এরপর প্রকাশিত হয়েছে ‘দূরে, হে হাওয়াগান’(২০২১) ও ‘বাবা ও দৃষ্টিঘোড়া’(২০২২)। ২০২৩ সালে শুভ্র সরকারের তৃতীয় কবিতার বই “সূর্যঘরের টারবাইনে” প্রকাশিত হয়েছে।  বইয়ের কবিতাগুলোয় তিনি প্রকৃতি আর বস্তুবিশ্বের মাঝে নিজের দেখার ভিন্নতাকে প্রতিষ্ঠা ও নবতর অর্থ তৈরিতে নিয়োজিত করেছেন নিজেকে। সহজ-স্বাভাবিকতায় প্রেম, অবসর, প্রাত্যহিকতা আর চারপাশের জটিল পরিসরকে কবিতায় নিয়ে এসেছেন তিনি। কয়েকটি কবিতার পঙ্‌ক্তি দেখা যেতে পারে,

“যত দূরে চিত্রকরের রেখা নীল
অসুখের হাত, যেন ঠিক
বিষণ্ণতার দিকে আগ বাড়ানো
হেঁটে চলা আমারই গান

মন বলে শেষ-বিকেল
ঘনিষ্ট দুপুরে পড়ে আছে আত্মহত্যার কিছু দাগ”
(আড়াল, সূর্যঘরের টারবাইনে)

“ফুলেরা গন্ধ ছড়াচ্ছে
আমি অবাক হয়ে দেখছি, কারো
উপস্থিতি ছাড়া
এমন একটা বারান্দা
কেমন এই পরিপূর্ণহীনতায়!”
(ফুলেরা গন্ধ ছড়াচ্ছে, ঐ)

“এ কেমন—
মনে পড়ার ভেতর কথা নিয়ে
বসে থাকছ তুমি

অথচ একটা মধুপুর
ভারী হয়ে আছে বৃষ্টিতে
ঝরা ভাব নির্জনতায়”
(দূরের, অতিপ্রিয়জন, ঐ)

“এখানে-সেখানে মুখ দেখার আকুলতা নিয়ে
আবছা হয়ে যাচ্ছে কিছু মানুষ

কাঠের বেঞ্চিতে বসে চা খেতে খেতে
কেউ আর জানতে চাচ্ছে না কী দুঃখ কার”
(ইসমাইলের চায়ের দোকান, ঐ)

এখানে কবিতাটিতে কবির দেখা আর উপলব্ধি অনায়াসেই অপরকে জড়িত করে নিজের মধ্যে, এতে করে এর মধ্যে সামষ্টিক চেতনার সঞ্চার হয়েছে। ‘তুমি’ তখন কবির কাছে সমষ্টির প্রতিনিধি, তবুও সেই তুমিও কবির ‘ব্যক্তিগত’ পরিধিতেই আছে। তাই দূরত্ব তৈরি না করে এটি গীতিকবিতা হয়ে ওঠে।

কবিতাগুলোয় যিনি দেখছেন আর বলছেন তার ভেতর এক গোপন ঔদাসীন্য আছে এবং এক বিরহের বোধ তাকে তাকে ঘিরে আছে। এর সঙ্গে প্রেম যুক্ত হলে বিষয়টি আরো জোরালো হয়। প্রায়শই ‘ব্যক্তিগত’কে কবিতাগুলোয় প্রবলভাবে উপস্থিত দেখতে পেলেও তারা পাঠকেরও হয়ে ওঠে। এই ‘ব্যক্তিগত’ পাঠকদেরও ব্যক্তিগত হয়ে তাদের সাথে একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলে। আর এসবের মধ্য দিয়েই নতুন এক অর্থপ্রবাহের দিকে যাত্রা শুরু হয়। উদারহণ হিসেবে একটি কবিতার উল্লেখ করা যায়,

“পাতা যেন লাবণ্য ধরে আলোর পড়ে
বাতাস ফিকে হয় আরতি করে
বারবার জীবন উন্মোচনে ভেসে গেলে
তুমিও জানো সকল কিছু একবারই মেলে”
(গতি, ঐ)

এখানে কবিতাটিতে কবির দেখা আর উপলব্ধি অনায়াসেই অপরকে জড়িত করে নিজের মধ্যে, এতে করে এর মধ্যে সামষ্টিক চেতনার সঞ্চার হয়েছে। ‘তুমি’ তখন কবির কাছে সমষ্টির প্রতিনিধি, তবুও সেই তুমিও কবির ‘ব্যক্তিগত’ পরিধিতেই আছে। তাই দূরত্ব তৈরি না করে এটি গীতিকবিতা হয়ে ওঠে।

বইটিতে প্রায়ই অসাধারণ চিত্রকল্প, উপমার দেখা মেলে, দুয়েকটি উদারহরণ দেখা যেতে পারে,

“পয়মন্ত মাছিরা তখনো
থেঁতলানো তরমুজে আরে কী হর্ষময়
রোদে মেঘস্তুপে পুড়ছে”
(নীলমাতম, ঐ)

“পাখিটি ভেজা অধিক
পর্দাহীন ছাতার মতো”
(শ্রাবণের বৃষ্টি, ঐ)

“হঠাত্ কী যেন বলতে গিয়ে, তারও উত্তরে
আরও মিথ্যা
ভাষা হারানো এ দুপুর”
(দরদচয়ন)

শুভ্র সরকার অপ্রমিত ক্রিয়াপদেও কিছু কবিতা রেখেছেন, এটিও বইটিকে বিশেষত্ব দিয়েছে। এই কবিতাগুলোতেও ভালোভাবেই তাকে পাওয়া যায়। সর্বোপরি, তাঁর কবিতাজগৎ আরো বিস্তৃত হয়েছে এ বইয়ে। বোধ প্রকাশনী যত্নের সাথে করেছে বইটি, আর এর প্রচ্ছদের অসাধারণ বানানলিপি তৈরি করেছেন আরেক কবি চঞ্চল মাহমুদ। আলোচনা শেষ করা যাক বই থেকে একটি কবিতার পঙ্‌ক্তি দিয়ে,

“এদিকে আমি সন্ধ্যা হয়ে আছি
আর বাদুরের গা থেকে ভেসে আসছে
বাকি জীবন।”
(সন্ধ্যা, ঐ)

শব্দকে নতুন করে তোলাই কবির মূল কাজ, এখানেও শুভ্র সরকারের হাতে শব্দগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে, তেমনি বইটিও।

সূর্যঘরের টারবাইনে
শুভ্র সরকার
প্রকাশসাল : ২০২৩
প্রকাশক : বোধ প্রকাশনী
দাম : ২৩০ টাকা।

বইটি কিনতে :

সূর্যঘরের টারবাইনে (Shurjaghorer Terbine) – বাহিরানা

 

(Visited 57 times, 1 visits today)

Leave a Comment