সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ আশির দশকের বাংলা কবিতার বাঁকবদলকারীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একজন। সম্প্রতি তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘তনুমধ্যা’ প্রকাশের ৩৭ বছর পর আবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। সেই উপলক্ষে আমরা তাঁর সাথে বইটিসহ আরো বিভিন্ন বিষয় যেমন, তাঁর সমসাময়িক কবিদের সাথে নিজের কবিতার সম্পর্কসূত্র, বর্তমান সময়ে মহাকাব্যের পুনর্জন্মের সম্ভাব্যতা, বর্তমান সময়ের কবিতার মূল্যায়ন, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। সাক্ষাৎকারটিতে আরও অনেক বিষয়ের সাথে তাঁর কবিতাবিশ্বে প্রবেশের এবং সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে প্রথম যোগাযোগের স্মৃতিও এসেছে। ‘তনুমধ্যা’ নিয়ে বাহিরানায় একটি রিভিউও প্রকাশিত হয়েছে কিছুদিন পূর্বে।
বাহিরানা : সুব্রত দা, ৩৭ বছর পর আপনার ‘তনুমধ্যা’ বইটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। বিষয়টি ভেবে কেমন বোধ করছেন?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ : কীভাবে দেখছি বলা কঠিন আসলে। প্রথম কবিতার বই আমার। লিখছি যখন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। বয়সটা বড়-বড় স্বপ্ন দেখে সামলাতে না-পারার। বেশিরভাগ বিপ্লবী যে-কিসিমের, আর বেশিরভাগ বিপ্লব ভ্রূণেই বিনষ্ট যে-কারণে হয়। তো, যত উঠেছি বেড়ে, বেড়েছে লজ্জা। যেন নিজের ন্যাংটা ছবি বেরিয়ে গেছিল কাগজে, তাকে যত ঢাকতে যাই, অমন হয়ই‑নি কিছু চাই ভাবতে, ভাবাতে, কোনো-না-কোনো শ্যালকেশ্বর খুঁচিয়ে তুলবেই সাপ: “আপনার ‘তনুমধ্যা’ কিন্তু ভালো হইছিল, তারপর কী হ’য়ে গেল?” মনে-মনে “ফালতুর বাচ্চা” আর মুখে হুঁ-হুঁ করি। “কী-যে বলেন।”
তবে সেই কালও এসেছি পেরিয়ে। এখন নিজের বালখিল্যতায় শরম না-পাই আর, মায়াই লাগে বুঝি, বেচারা। সময়কালে প্রেম না-জোটায়, আবালটা কী-সব আতাকামা বানায়ে রাখছে দিকেদিগন্তরে।
পুত্র তানিম প্রস্তাব দিল যখন বাপের আদ্যশ্রাদ্ধ বা গায়েবি জানাজার, দ্বিমত করলাম না। মড়ার আবরু কী। করুক, পোলা-ই শেষ গা ধোয়াক।
বাহিরানা : পুনরায় ছাপা-হওয়া ‘তনুমধ্যা’য় কি কোনো সম্পাদনা করেছেন?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ : সম্পাদনা বলতে যা বোঝায়, তা করতে গেলে এটা আবার লিখতে হ’ত। তাই দুইএকটা অবভিয়াস চ্যুতির বাইরে বদলাই-নি আর কিছুই। গার্বেজ বিনে ববিতার ছবি এঁকে কী লাভ। যে হাস্যকরতাগুলি দেখে লজ্জায় বোরকা আগে পরতাম, এবার খালি হাসলাম, দিল খুলে। “হায় রে, জীবনের এ কী পরাজয়!”
বাহিরানা : ‘তনুমধ্যা’র প্রথম অংশ ‘তামাদি’তে একটা মহাকাব্যিক আঙ্গিক ও আবহ আছে। তামাদি খণ্ডটি রচনার পেছনে আপনার কোন্ স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছিল?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ : “মহাকাব্যিক আঙ্গিক ও আবহের” আকাঙ্ক্ষাই করেছিল কাজ। আকৈশোর মধুভক্ত, আবার তদানীং ইংরেজির ছাত্র, এলিয়টের পাঁড় সাকরেদ। দুইয়ে মিলে লিখিয়ে চলল। শেষ লেখাটা, ‘সাহারা’, লেখা হয়েছিল, বা শুরু হয়েছিল, আরও আগে। তিনটা লেখাই প্রায় ইন-প্যারালেল লেখা হচ্ছিল তখন, ইংরেজি বিভাগের সামনের করিডরের রেলিঙে ব’সে-ব’সে। নিদ্রার চেয়ে এবাদত ভালো যদি, ক্লাস করার চেয়ে কবিতা কেন নয়। পাশ করার চেয়েও ভালো, সো টু স্পীক। কবিতা হোক না-হোক, একটা ব্যাপার হয়েছিল এতে। ট্র্যাভ্যর্সিং আ টেরেন দ্যাট ওয়াজ ওনলি মাইন। নিজের রাজ্য ঘুরে দেখতে বেরিয়েছে, জীবনে প্রথম, গ্লাসহাউসে বড়-হওয়া যুবরাজ সিদ্ধার্থ। সঙ্গে সুগ্রীব দোসর ছিলেন… নেশা…
বাহিরানা : আপনার প্রজন্মের কবিদের কবিতার সাথে আপনার রচিত কবিতাসমূহের মৈত্রী বা স্বাতন্ত্র্য বিষয়ে কিছু বলুন?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ : কবিতার যাত্রাপথে কোনো বন্ধুর দেখা ঢের পরে পেয়েছি। শুরুটা নিঃসঙ্গ শেরপারই ছিল। তারপর হুট ক’রে হুড়মুড় এসে গেল হগ্গলে। ঢা.বি.-তে সহপাঠী হ’য়ে এল সৈয়দ তারিক, আর সবার সাথে পরিচয়টা সে-ই ঘটিয়ে দিয়েছিল। খোন্দকার আশরাফ হোসেন স্যর ছিলেন, সহজ-মতো মানুষ। অন্য স্যর-ম্যা’মদের বিরক্তির ভয়ে তাঁদের ছায়া দেখলে জীবনের মায়া কেটে যেত, আশরাফ স্যরের (আমরা আড়ালে ডাকতাম ফকির আলমগির, বা, ফকির হালুমগির) রুমে উঁকি দিয়ে উনি নাই দেখামাত্র আমি সুড়ুৎ ঢুকে প’ড়ে সিগারেট চুরি করতাম।
পরে একে-একে সাজ্জাদ শরিফ, শান্তনু চৌধুরী, শোয়েব শাদাব, সেলিম মোরশেদ, শামসুল কবির (কচিভাই, ওরফে ইচক দুয়েন্দে), আমানউল্লাহ, বিষ্ণু বিশ্বাস, অসীমকুমার দাস, ফরিদ কবির, মঈন চৌধুরী (ভাই), স্বদেশবন্ধু সরকার, কত নাম বলি, সবাই এসে পড়ল আর আমি হঠাৎ একা-একা সুত্রাপুরের গলিতে চামড়াছেঁড়া বল খেলতে-খেলতে হঠাৎ দেখি ঢাকা স্টেডিয়ামে মাঠভর্তি খেলোয়াড়ের মাঝখানে নিজেকে। আমার মতো দেখতে-শুনতে তারা, আমার কাছাকাছি বয়স, আর কী-চৌকস! যেন তেল গ’লে পড়ছে, এমন চকচকে। বিশেষতঃ তারিক, অসীমদা, কচিভাই, বিষ্ণু, সাজ্জাদ… আহা। কার লেখা কেমন, বিশেষ ক’রে আমার তুলনায়, তার বিচার করা অসম্ভব আমার পক্ষে। ওদের সবারই, সব লেখাই আমার, যেমন আমারগুলি ওদের। লজ্জা এ-জন্যেও কম পাচ্ছি আজকাল। আমার লজ্জার ভাগও-তো তাদের নেওয়া চাই, গোপাল ভাঁড়ের ইয়ার হওয়া কেন তবে।
বাহিরানা : আপনার রচিত ‘তনুমধ্যা’র মতো এমন অনেক গ্রন্থ দীর্ঘ অপ্রাপ্তির কারণে পাঠকের স্মৃতির জগতে স্থান নেয়। ‘তনুমধ্যা’র এই ফিরে আসা নিশ্চয়ই পুরনো পাঠকদের স্মৃতির জগতে আলোড়ন তুলবে। লেখক হিসেবে আপনার স্মৃতিতে কেমন অনুরণন তুলছে এই নতুন ‘তনুমধ্যা’?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ : কারো মনে কিছু তুলবে না। কবিতা পড়ে কোন্ বেকুব। আমার অবস্থা তথৈবচ। নো সেন্সেশন। মানে “চেতনা” আমাকে ছোঁয় না এমনিতেই। রাজাকার বলে কেউ-কেউ। কা তে কান্তা, কস্তে পুত্র… প্রজাই বা কার, রাজাই বা কার… এই বই হ্যাড বেটার হ্যাভ বীন লস্ট উইদাউট আ ট্রেস। তানিম আজীবন পস্তাবে, এটুকুই আমার সুখ।
বাহিরানা : এ-সময়কার কবিদের কবিতার গতি-প্রকৃতি নিয়ে আপনার অভিমত কী বা কিভাবে দেখছেন।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ : এ-সময়ের কবিদের আমি চিনি না, তাদের কবিতাও পড়ি না। মানে, কবিতা আমি কোনোসময়েরই পড়ি না, সময় নষ্ট (মানে, সময় থাকে যদি আরকি)। তাছাড়া, আমি অত নির্বিকার-নির্বিচার হ’তে পারি না আসলে। মানে, কবি যেমনই হোক, কবিতাই আসল… এমন নির্বিরোধী সন্তসুলভ আচরণ আমাকে দিয়ে হবার নয়। আমি যেহেতু কবিদের নাড়ি চিনি, তাদের লেখা পড়ার উৎসাহ জোগাতে-জোগাতে সময় পাল্টে যায়, কবি আর কবিতা উধাও হ’য়ে, থাকে শুধু অন্ধকার। আগে ব’লে গালি খেয়েছি এক-শব্দকল্পদ্রুম, তাও আবারও বলি, আমাদের এই সময়টায়, কয়েকজন মেয়েই শুধু অথেনটিক কবিতা লিখছে। পুরুষ কবিরা জাহান্নামের চৌরাস্তায়। তাদের মাগিফেরাত কামনায়…
বাহিরানা : ‘তামাদি’র সূত্র ধরেই বলি, আধুনিক কালে মহাকাব্য রচনার সম্ভাবনা ও বাস্তবতা কতটুকু? এ কালে এমন চেষ্টা কারা কারা করেছেন, এ বিষয়ে একটু বলুন।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ : সম্ভাবনা শূন্য। চলচ্চিত্রে, হয়তো, সম্ভব হ’লেও হ’তে পারে। কবিতা, বা সাহিত্যে নৈব নৈব। আমাদের দেশে হৈব-তো না-ই। একদিকে সত্তরের মুক্তিযুদ্ধমার্কা স্লোগানকাব্য আর অন্যদিকে আধুনিক হামদ-নাত, এর বাইরে কোনো কবিতা থাকে যদি-তো, তা লিখবে শুধুই মেয়েরা, আফগানিস্তানের মেয়েরা গোপনে লেখে যেমন, জীবনবাজি। কিন্তু মেয়েদের দ্বারা কবিতা হ’লেও, মহাকাব্য হবার হয়তো নয়। হয়-নিও কখনও। কারণ তারা জানে, মহাকাব্য দিয়ে হয় কচু, মহাকাব্য=মহাঅপচয়, আমাদের হাজার-হাজার-কোটির রাস্তাগুলির মতো, পরের বর্ষায় যারা ধুয়ে চ’লে যায়।
বাহিরানা : ‘তনুমধ্যা’ রচনার প্রেক্ষাপট ও বইটির নামকরণের ইতিহাস জানতে চাই।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ : প্রেক্ষাপট-তো বলেছি আগে। তিনটা কবিতা লিখে যাচ্ছিলাম, একই সাথে… আসলে তিনটাই অনেক-অনেক ছোট-ছোট কবিতার মন্তাজ-মাত্র। পরিকল্পনাহীন, বেলাগাম, হুতোমপেঁচার মকশা। শিরোনামটা এসেছে একটা সংস্কৃত ছন্দের নাম থেকে, কিন্তু সেই ছন্দের সাথে কবিতাগুলির সম্পর্ক কোনো নাই। শব্দটা পছন্দ হ’ল। কবিতাগুলির মধ্যে সবচেয়ে ছোটটা মধ্যে থাকাতে, সেই অর্থটাও ধরা থাকল নামে, মানে তনু=চিকন মধ্যভাগ যার, সেই নারী। রূপসীরা নাকি হয় অমন, আমি ঠিক জানি না। নারী… আমি চিনি না। “সেই নারী শুধু আকাশের গায়ে চলে ফেরে আর তারার নিমেষ গোনে…”।
বইটির বাহিরানা রিভিউ :
তনুমধ্যা— সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ— প্রকৃতি আর বস্তুনিচয়ের সাথে গোপন ফিসফাস – বাহিরানা (bahirana.com)
বইটি কিনতে :
তনুমধ্যা – বাহিরানা (bahirana.com)