বাহিরানা

এস এম সুলতান : স্বদেশ প্রকৃতি মানুষ— জীবন, রঙ ও ভাষার সন্ধানে


কিংবদন্তী চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের আসন্ন জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশের কিংবদন্তী পোট্রেট শিল্পী নাসির আলী মামুনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে “এস এম সুলতান : স্বদেশ প্রকৃতি মানুষ”। সুলতানের চিত্রকর্মের মতো তাঁর জীবনও এখন পর্যন্ত অনেকটাই রহস্যাবৃত। কবি, চিন্তক, কথাশিল্পী আহমদ ছফা তাকে রহস্যের জাল কেটে বের করে নিয়ে এসেছিলেন, তা আমরা জানি, কিন্তু এরপর এত এত খ্যাতি এবং মূল্যায়িত হবার পরেও তাকে এখনও আরো গভীর ও সম্পূর্ণঅর্থে আবিষ্কারের প্রয়োজন রয়ে গেছে। বইটি সেই দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে বলা যায়। নতুন গবেষকদের নিয়ে সেরকম আশার কথাও আমাদের জানিয়েছেন সম্পাদক। কিন্তু এখন পর্যন্ত যারা সুলতানকে নিয়ে লিখেছেন— যাদের প্রকৃত অর্থেই এই শিল্পীকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা ছিল— সেই লেখাগুলোর কি হবে। নতুন প্রজন্মের চিত্রশিল্পী, সমালোচক, সাহিত্যিক, গবেষকদের জন্য সুলতানকে বুঝার এবং সংশ্লেষণের জন্য এই লেখাগুলো অতীব গুরত্বপূর্ণ। আলোচ্য বইটিতে খুব ভালোভাবেই কাজটি করা হয়েছে। বিশেষ করে, ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে এই চিত্রশিল্পীর একক চিত্র প্রদর্শনীর পর যে লেখাগুলো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, প্রাথমিকভাবে যে প্রবন্ধ, আলোচনাগুলো সুলতানকে খ্যাতির শিখরে তাঁর প্রাপ্য জায়গার অধিষ্ঠিত করেছে। সেগুলোসহ সাম্প্রতিকালের লেখাগুলোকেও বইটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো সুলতানের চিত্রকলাকে আরো গভীরভাবে অনুধাবনের দুয়ার উন্মোক্ত করেছে।

বইটিতে চিত্রকলায় এস এম সুলতানের নিজস্ব ভাষাকে স্পষ্ট করার ইঙ্গিত ধরে আছে এর সবগুলো লেখার সমগ্রতায়, তাই সেই ভাষার পেছনের দর্শনও উন্মোক্ত হয়, এবং এসবের মধ্য দিয়ে শিল্পীর নিজস্ব রঙ আর রেখা অন্যভাবে ধরা দেয় বর্তমানের ইতিহাসে।

বইটিতে বাংলাদেশের চিত্রকলায় বা ভারতীয় শিল্পঐতিহ্যে এস এম সুলতানের জায়গা কোথায়, কী বিশেষত্ব তাঁর, কেমন নতুনত্ব তিনি যোগ করেছিলেন সমকালীন চিত্রকলায়— তার সবই উঠে এসেছে। লেখকদের মধ্যে আবুল মনসুর, জসীম উদ্‌দীন, আব্দুর রাজ্জাক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ থেকে রয়েছেন হাসনাত আবদুল হাই, আলম খোরশেদ, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ তারিক, এজাজ ইউসুফী, আব্দুস সাত্তারসহ মইনুদ্দীন খালেদ পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাম। একজন শিল্পীর কাজকে যত বিস্তৃতভাবে স্পর্শ করা যায় তার প্রায় সবই ধরা আছে এই সংকলনে। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি লেখার শিরোনাম দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে, যেমন আবুল মনুসুরের লেখার শিরোনাম, “এস এম সুলতান : সৃজনশীল ও প্রান্তিক মানসের দায়” আব্দুর রাজ্জাকের লেখার শিরোনাম, “সুলতানের ছবি” এইভাবে জসীম উদ্দিনের, “হলদে পরীর দেশে” আলম খোরশেদের লেখার শিরোনাম, “আমার কাছে ‘সুলতান’ আছে” এজাজ ইউসুফী’র লেখার শিরোনাম, “এস এম সুলতান : পুনরুদ্ধারের শিল্পকলা”। এরমধ্যে কোনো কোনো লেখায় উঠে এসেছে লেখকদের সাথে ব্যক্তি সুলতানের কিভাবে পরিচয় হয়েছিল, সামগ্রিকভাবে, তাঁরা কিভাবে তাঁকে দেখেন, তাঁর বিচিত্র জীবনপদ্ধতির বয়ান এবং সেইসাথে তাঁর চিত্রকর্মের সাথে তাঁদের বোঝপড়া।

আলোচ্য বইয়ের চিত্রশিল্পী বাংলার কৃষকদের পেশীবহুল করে আঁকতেন। এর পেছনে তাঁর নিজস্ব দর্শন রয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজকৃত তৃতীয়বিশ্বে এনজিও কর্মকাণ্ড নিয়ে উনার বিরূপ মনোভাবের কথা তিনি বলেছেনও। আদতে কৃষককে এভাবে উপস্থাপনের পেছনে অতীতকে ভবিষ্যতের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রবণতা আছে, যেটা বর্তমানে আমরা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। বইটিতে চিত্রকলায় এস এম সুলতানের নিজস্ব ভাষাকে স্পষ্ট করার ইঙ্গিত ধরে আছে এর সবগুলো লেখার সমগ্রতায়, তাই সেই ভাষার পেছনের দর্শনও উন্মোক্ত হয়, এবং এসবের মধ্য দিয়ে শিল্পীর নিজস্ব রঙ আর রেখা অন্যভাবে ধরা দেয় বর্তমানের ইতিহাসে। সম্পাদক নাসীর আলী মামুনের পরিচ্ছন্ন সম্পাদনা এবং সেইসাথে বিভিন্ন অঙ্গনের গুণীজনদের লেখা দুই মলাটের ভেতর নিয়ে আসা সংকলনটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। বইটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বৈশ্বিক হয়ে উঠা চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে দর্শক-পাঠক-বোদ্ধাদের আরো ঘনিষ্ট করে তুলবে এই প্রত্যয় জন্ম দিয়েছে।

এস এম সুলতান : স্বদেশ প্রকৃতি মানুষ
সম্পাদনা : নাসির আলী মামুন
প্রকাশক : বাতিঘর
প্রকাশকাল : ২০২৩
দাম : ৫৬০ টাকা।

(Visited 38 times, 1 visits today)

Leave a Comment