এই বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন নরওয়ের কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও কবি ইয়ন ফসে। পুরস্কার পাওয়ার পর পৃথিবীজুড়েই তাঁর লেখার সাথে পরিচিত হবেন সব ভাষার নতুন পাঠকগোষ্ঠী, কিন্তু ইয়ন ফসে’র বিপুল সাহিত্য সম্ভারের কোন্ জায়গা থেকে শুরু করতে হবে পাঠ? এ এক বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এর সমাধান দিতে নিউ ইয়র্ক টাইমসের আমন্ত্রণে লিখেছেন ‘জওমানা খতিব’ ও ‘টিনা জর্ডান’। তাঁরা ইয়ন ফসে’র সাহিত্যকর্ম থেকে নির্বাচিত কথাসাহিত্য ও নাটকের তালিকা তৈরি করেছেন নতুন পাঠক, সমালোচক এবং অনুবাদকদের জন্য। গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন লেখক, অনুবাদক ও চলচ্চিত্র সমালোচক মামুনুর রশিদ তানিম।
সদ্যই, সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হলেন নরওয়েজিয়ান লেখক এবং নাট্যকার ইয়ন ফসে। দীর্ঘ কয়েক দশকের ক্যারিয়ারে, নাট্যকার এবং লেখক ইয়ন ফসে’র উল্লেখযোগ্য সৃষ্টির সংখ্যা কম নয়। তাকে তুলনা করা হয় স্যামুয়েল বেকেট, হেনরিক ইবসেনের মতো শ্রেষ্ঠ নাট্যকার এবং সাহিত্যিকদের সাথে। এমনকি এই তুলনার তালিকায়, দ্য বিটলস ব্যান্ডের জর্জ হ্যারিসনের নামটিও আছে।
প্রায়শই তাঁর লেখাগুলোতে ফুটে উঠতে দেখা যায়, কিছু বিচ্ছিন্ন; একাকী চরিত্রের ব্যক্তিগত জীবনযাপন। অন্তরঙ্গতা মিশিয়ে লেখা। বাক্য ফুরিয়ে গেলেও, ভাবটা জড়িয়ে থাকে। ২০১৮ সালে ‘দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’ পত্রিকার একটি সাক্ষাতকারে ফসে বলেছিলেন, “আমার বই কেউ গল্পের জন্য পড়ে না।”
দামিয়ন সার্লস, ফসে’র লেখার ইংরেজি অনুবাদকদের একজন। ২০১৫ সালে ‘দ্য প্যারিস রিভিউ’ সাহিত্যপত্রিকায় ফসে’র কাজ নিয়ে বর্ণনা করতে গিয়ে সে লিখেছিল, “দ্য বিটলস ব্যান্ডের চার নায়কের কথা ভাবুন। এবার সেই কথার পিঠে নরওয়েজিয়ার চার চমৎকার সাহিত্যিকের কথা ধরুন। পার পিটারসনকে ভাবতে পারেন রিঙ্গো হিসেবে; একদম খাঁটি এবং মৌলিকত্ব নিয়ে সবসময় ভরসা করা যায়, এমন একজন সে। দাগ সোলস্তাদ’কে ভাবতে পারেন জন লেনন; সবসময় উদ্ভাবনী চিন্তাধারা আর নিরীক্ষার মধ্যে থাকে। কার্ল ওভে নাউসগার্দ হলো পল ম্যাকার্থি; সবচেয়ে মিষ্টি, নরোম স্বভাবের লেখক। আর ফসে হলো জর্জ হ্যারিসন; চুপচাপ, রহস্যময়, লেখায় থাকে আধ্যাত্মিক ভাব এবং সম্ভবত সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কারিগর নিজ কাজের।”
তাঁর কাজগুলো অনেক বেশি সূক্ষ্ম এবং প্রকৃতির দিক থেকে; অস্তিত্ববাদের জিজ্ঞাসায় আগ্রহী থাকে সর্বদা। প্রায়শই তাঁর লেখাগুলোতে ফুটে উঠতে দেখা যায়, কিছু বিচ্ছিন্ন; একাকী চরিত্রের ব্যক্তিগত জীবনযাপন। অন্তরঙ্গতা মিশিয়ে লেখা। বাক্য ফুরিয়ে গেলেও, ভাবটা জড়িয়ে থাকে। ২০১৮ সালে ‘দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’ পত্রিকার একটি সাক্ষাতকারে ফসে বলেছিলেন, “আমার বই কেউ গল্পের জন্য পড়ে না।”
তো সদ্য নোবেল জেতা এই সাহিত্যিকের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি নির্দেশিকা রইলো এই— ( কোথা থেকে পড়া শুরু করতে হবে, তাই নিয়ে)
সেপ্টোলজি ১-৭
ফসে, ক্যাথোলিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে উঠবার সময়টাতেই, অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম ‘সেপ্টোলজি’র এই ৭’টি উপন্যাস লেখা হয়েছে। ঐশ্বরিক ভাবসমৃদ্ধ এই উপন্যাসগুলোয়, বার্ধক্যের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া একজন শিল্পীর নিজের জীবন নিয়ে ধ্যানধারণা প্রতিভাত হতে দেখা যায়। র্যান্ডি বোয়াগার্দা তার পর্যালোচনায় এই বইগুলো নিয়ে লিখেছেন, “প্রত্যেকটা উপন্যাস একই আবহে শুরু হয়। ধর্মপ্রচারক সেইন্ট এন্ড্রু’র ক্রুশবিদ্ধ হবার ঘটনা নিয়ে একটি চিত্রকর্ম তৈরি করতে চায় আইল। সেই ঘটনা নিয়ে, অন্তর্ভেদী চিন্তা দিয়ে উপন্যাসগুলোর শুরু হয় এবং লাতিন প্রার্থনাসঙ্গীত দিয়ে প্রতিটার সমাপ্তি হয়। তবে শেষ উপন্যাসটায় পাওয়া যায় ভিন্ন চিত্র।”
মর্নিং এন্ড ইভিনিং
আকারে নাতিদীর্ঘ কিন্তু ভাবে বিস্তৃত এবং শক্তিশালী এই উপন্যাসিকার শুরু হয়, জোহানসের জন্মের সময়কার ঘটনা দিয়ে। তাকে ঘিরে তার মা-বাবার একটাই নিয়ত, ছেলে যেন বাবার মতোই জেলে হয়, বড় হয়ে। অনেক বছর পরে, জোহানস তখন বৃদ্ধ; সে একাকী মনে নিজের পরিবার আর বন্ধুদের ঘিরে যেই জীবনটা কেটে গেছে, সেই জীবনের দিকে আরেকবার ফিরে তাকিয়ে নিজেকে অনুভব করতে চায়। (তবে হ্যা, বাবা-মা’র চাওয়া অনুযায়ী, জেলে হতে পেরেছিল সে।)
মেলানকলি ১ ও ২
এই দুটি উপন্যাস, উনিশ শতকের নরওয়েজিয়ান চিত্রশিল্পী লার্জ হাৎজারভিগের জীবনের একটি কাল্পনিক রূপ বর্ণনা করে। ডাসলডর্ফে পড়ার সময় হাৎজারভিগ তার মেধাশক্তি নিয়ে অনেক বেশি দুশ্চিন্তায় বাঁধা পড়ে গেছিল, যেটা একরকম তাকে বাতিকগ্রস্ত করে তোলে। এবং ডাসলডর্ফে, সে যেই বাড়িতে থাকতো ওই বাড়ির মালকিনের মেয়ের প্রতি আকর্ষণের কারণে, তাকে মাথার ছাদও হারাতে হয়েছিল পরবর্তীতে। এবং ওই মেয়ের প্রতি অপ্রতিরোধ্য যৌন আকর্ষণ তাকে বিভ্রান্ত করে তোলে, যার কারণে ধীরেধীরে পাগলে রূপান্তরিত হয় এই লার্জ হাৎজারভিগ চরিত্রটি।
অ্যালিস এট দ্যি ফায়ার
সিগনে নামের এক নিঃসঙ্গ নারী, তার গ্লানিভরা জীবন নিয়ে হাঁপিয়ে উঠে। আর ভাবে, ২০ বছর আগের সেই দিনটির কথা। নৌকা নিয়ে বেরিয়ে, তার স্বামী যেদিন আর ফিরে আসেনি। তবে তার এই চিন্তাগুলো শীঘ্রই একটা অদ্ভুতরকমের মেটাফিজিক্যাল জায়গায় পৌঁছায়। এবং শুধু ২০ আগের স্মৃতি নয়, বরঞ্চ তার পরিবারের আরো অনেক অনেক আগের প্রজন্মের স্মৃতিও মনে আসতে থাকে সিগনের! সমুদ্রের খাঁড়ির পাশে বাস করা সিগনে, তখন সেই মেটাফিজিক্যাল জগতে ধ্রুবক হয়ে ঘুরতে থাকে শোকের আর বেদনার সকল স্মৃতির মাঝে!
আ শাইনিং
একজন নামহীন বয়ানকারীর বয়ানে এগোয় এই গল্প। রাতের অন্ধকারে, নরওয়ের নির্জন বনজঙ্গলের মাঝ দিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে গাড়ি ছোটাচ্ছিল সে। একসময় কাদামাখা রাস্তায় ফেঁসে যায় তার গাড়ির চাকা। দিকভ্রান্ত এই ব্যক্তি তখন প্রথমবারের মতো নেমে আসে গাড়ি দিকে। নেমেছে কারণ, একটা অদ্ভুত কিছু তার দৃষ্টিগোচর হয়। গাড়ি থেকে নেমে সে দেখতে পায়, একটা জ্বলজ্বলে সাদা আলো এগিয়ে আসছে তার দিকে!
ফসে’র সাহিত্য সংস্থা এই উপন্যাস সম্পর্কে বলেছিল, “জীবন আর মৃত্যুর সীমারেখা নিয়ে একটি অভিভূতকারী উপন্যাস।”
বোটহাউস
সাধুসন্ন্যাসীর জীবন বেছে নেওয়া এক লোকের আচমকা সাক্ষাত হয় তার বন্ধু আর বন্ধুপত্নীর সঙ্গে। কিন্তু নির্দোষ এই সাক্ষাতই যে, ত্রিকোণ ভালোবাসার জটিল দ্বন্দ্বে তাদেরকে জড়িয়ে ফেলবে, তা কি কেউ জানতো!
মঞ্চনাটক
আই এম দ্য উইন্ড
ধরা হয়, জীবন্ত নাট্যকারদের মাঝে ফসে’র নাটক গোটা ইউরোপজুড়ে সবচেয়ে বেশিবার মঞ্চায়িত হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় মঞ্চায়ন অবশ্য, বেশ কমই হয়েছে। তো ফসে’র এই “আই এম দ্য উইন্ড” নামক অস্তিত্ববাদী মঞ্চনাটকটি, মাছ ধরার নৌকায় বসে থাকা দুটো লোককে ঘিরে। ২০১৪ সালে টাইমস ম্যাগাজিনের এক সমালোচক লিখেছিলেন, “ফসে’র এই ছান্দিক এবং বাহুল্যবর্জিত চিত্রনাট্যটি মানুষের নিজস্ব পরিচিতি নিয়ে একদম প্রাথমিক প্রশ্নগুলো প্রখর সাহস আর উৎকন্ঠার সাথে তোলে।”
আ সামার ডে
এই নাটকটি মনে করিয়ে দিবে ‘অ্যালিস এট দ্যি ফায়ার’ এর কথা। আবেগপূর্ণ এই নাটকের কেন্দ্রে দেখা যায়, দুঃখী এক নারী অবিচল রূপে নিজ স্বামীর, যে কিনা পেশায় জেলে, ফিরে আসার প্রহর গুনছে। এই অপেক্ষার মাঝেই এক সুস্পষ্ট শঙ্কা কাজ করে। দ্য টাইমস-এর এক সমালোচক নাটকটি সম্পর্কে লিখেছিল, “খুবই শক্তিশালী কিন্তু অনেকখানি চুপিসারেই এই নাটকের নাটকীয় মুহূর্তগুলো তৈরি হয়। যা একটা ভিন্ন আঙ্গিক যোগ করে এই নাটকে।”
সামওয়ান ইজ গোয়িং টুঁ কাম
হিংসা, উদ্বেগ, ভীতি আর যৌনতা নিয়ে টেনশনে ভরা এই নাটক আবর্তিত হয় এক দম্পতিকে ঘিরে। সমুদ্রের পাড়ে একটা নির্জন, জীর্ণ ঘরে উঠে তারা। কেউ বাঁচাতে আসার চিন্তাও যেখানে করা যায় না, সহসা!
দ্য নেইম
এক যুবতী, সদ্যই যে জানতে পেরেছে নিজের গর্ভবতী অবস্থা সম্পর্কে, অসহায় হয়ে অনাগত বাচ্চার বাপকে নিয়ে তার নিজ মা-বাবার ঘরে উঠে। বাবা-মা জানে না যে, তাদের মেয়ে বাচ্চা জন্ম দিতে চলেছে। এবং তাদেরকে জানাতেও পারে না এই যুবতী। না বলতে পারার এই পীড়া, দুশ্চিন্তা এবং সেখান থেকে উদ্ভূত ক্লস্ট্রোফোবিক প্রকৃতি নিয়েই এই মঞ্চনাটক।