সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ফাহাদ আল আবদুল্লাহ’র নতুন রহস্য উপন্যাস ‘গারদ’। নামের মতোই অস্বস্তি জাগানিয়া কিন্তু উত্তেজনাকর ঘটনা আর অঘটনে পূর্ণ এক শহরের গল্প এ বইয়ের উপজীব্য। লেখকের ‘শহর’ উপন্যাসটির মূল চরিত্রদের অনেককেই পাওয়া যায় এবং পূর্বঘটনার অনেক স্মৃতিসূত্র রয়েছে বইটিতে। যেমন ডিটেক্টিভ মাশরুরই এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাই একে সিরিজ উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব বলা যায়। আর বরাবরের মতোই লেখক, তার চরিত্রদের শক্তি আর দুর্বলতার পরীক্ষা চালিয়েছেন তাদেরকে বিপদজনক সব পরিস্থিতির মুখোমুখি করে। যেখানে থেকে বেঁচে ফিরতে নিজের শক্তিই মূল ভরসার জায়গা। এসবের সাথে টুইস্ট তো আছেই। আর ভাষার কাব্যিকতাও বড় একটি অংশ দখল করে আছে উপন্যাসটির, এই কাব্যিকতার ফলে চরিত্রদের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব, বিষণ্ণতা আর একটা শহরের চিত্রকল্প পাঠকদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
রাজনীতি নাকি খুনির নিজস্ব মনোদৈহিক কারণ— কোনটা এর মূলে? পাঠকদের কাছে যখন এরকম সন্দেহ ভালোভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, আর ইতিহাসেও যেহেতু দেখা গেছে সূত্রের দ্বৈত বৈশিষ্ট্যের কারণে বড় বড় অপরাধও ছোট কোনো সাধারণ অপরাধের পেছনে মুখ গুজেছে। তখন পাঠকরাও মাশরুরের সাথে রহস্যের সুলুক সন্ধানে নেমে পড়েন।
বইটির গল্পের কাঠামো এরকম, মাশরুরের কাছে একটা সিরিয়াল কিলিংয়ের কেস এসে পড়ে। বিষয়টি তার কাছে নিয়ে আসে মির্জা গালিবের প্রাক্তন স্ত্রী, সে আবার তাদের পুরনো বন্ধুও। হঠাৎ উদ্ভুত এই হত্যা ঘটনাগুলোয় নির্দিষ্ট কিছু পরিবারগুলোকে বাছাই করা হচ্ছে। তাই বিষয়টি আর সাধারণ থাকে না। চাঞ্চল্য আরও বেড়ে যায়, যখন দেখা যায় তখন শহরে নির্বাচনের মৌসুম চলছে। হত্যাকাণ্ডগুলোর সাথে কী রাজনীতির কোনো যোগ রয়েছে? কারা এর পেছনে? এসবের তদন্ত করতে রাস্তায় নামে মাশরুর, সঙ্গে এক করিতকর্মা পুলিশ অফিসার।
প্রকৃত অপরাধী কি একজন নাকি সংঘবদ্ধ কোনো গোষ্ঠী? পাঠকদের মনে এরকম দ্বিধাবিভক্ত পরিস্থিতির আভাস সৃষ্টি হয়, সঙ্গে আরো অনেক সন্দেহ দানা বাধে। কেননা সিরিয়াল কিলারের বৈশিষ্ট্য দুইদিকে হেলে পড়ছে। রাজনীতি নাকি খুনির নিজস্ব মনোদৈহিক কারণ— কোনটা এর মূলে? পাঠকদের কাছে যখন এরকম সন্দেহ ভালোভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, আর ইতিহাসেও যেহেতু দেখা গেছে সূত্রের দ্বৈত বৈশিষ্ট্যের কারণে বড় বড় অপরাধও ছোট কোনো সাধারণ অপরাধের পেছনে মুখ গুজেছে। তখন পাঠকরাও মাশরুরের সাথে রহস্যের সুলুক সন্ধানে নেমে পড়েন। মাশরুর হার মানার পাত্র নয়, প্রকৃত ঘটনা তাকে বের করতেই হবে, তবে রয়েছে জীবনের বড়রকমের ঝুঁকি, আর সেইসাথে শহরের মানুষের জীবনও বিপন্নতার দিকে মোড় নিচ্ছে। তাদের রক্ষা করার গুরুভার দায়িত্ব বর্তেছে তার কাঁধে। সামগ্রিক পরিস্থিতির চাপে উপন্যাসটি ক্রমেই এক গারদে পরিণত হয়, মাশরুরই এর থেকে উত্তরণের শেষ ভরসার জায়গা।
উপন্যাসটির একটি বিশেষ দিক হলো এটি পাঠকদেরকেও এরসাথে যুক্ত করে নেয়, অধ্যায়ের পর অধ্যায় পড়তে পড়তে একসময় পাঠকরাও একজন সুদক্ষ গোয়েন্দা হয়ে ওঠেন যেন। আর পূর্বের ‘শহর’-এর সাথে যোগসূত্র বইটিকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। পরিচ্ছন্ন প্লট, ভাষার কাব্যিকতা, আশংকা, উত্তেজনা— সব মিলে এক মনোহর বিপদজনক ভ্রমণ হয়ে ওঠে ‘গারদ’। আর, লেখক বইটির অগনানুগতিক চমকপূর্ণ উপসংহার টেনেছেন, এটিও ‘গারদ’কে ভিন্ন উচ্চতা দিয়েছে। বইটি পাঠকদের অচেনা এক ‘শহর’-এ উপস্থিত করবে। ‘গারদ’ থেকে কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করে শেষ করা যাক আলোচনা :
“অবাধ্য কুয়াশার আঁচড়ে সেবারের ডিসেম্বর ছিল খ্যাপাটে। প্রতি মুহূর্তে শহরটাকে আরো নি:সঙ্গ, আরো একাকী করে দিচ্ছিল শীতের হিংস্র আগ্রাসন; জাঁকিয়ে বসেছিল অমরাবতীর হৃদপিণ্ডেও। সাথে যোগ হয়েছিল মানুষের পাশবিকতার একের পর এক প্রমাণ।”
(গোলকধাঁধা, গারদ)
গারদ
ফাহাদ আল আবদুল্লাহ
প্রকাশক : মাতব্বর কমিকস এন্ড পাবলিকেশন
প্রকাশসাল : জুলাই, ২০২৩
দাম : ৩৮০ টাকা।