এমন বিষয় আমাদের প্রায়ই কৌতুহলী করে তোলে— বাংলা সাহিত্যের কোনও একজন গুরুত্বপূর্ণ কবির একটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ধরা যাক দুই কি তিন দশক আগে। প্রকাশের পরপরই বহুল আলোচিত ও সমালোচিত। সময়ের ধারাবাহিকতায় আর দীর্ঘ অপ্রকাশের বন্ধ ডাকঘরে পড়ে থাকার ফলে এক পর্যায়ে পাঠকের স্মৃতি ও শ্রুতির জলধির ঢেউ পেরিয়ে একদা অনুরাগীজনের মননে প্রত্নপ্রতীকের উপমায় ঠাঁই লয় সেই গ্রন্থ। যাঁদের পাঠ-অভিজ্ঞতায় আছে সেই প্রকাশনা, তাঁদের কথন কিংবা অতিকথন আকাঙ্ক্ষার দীপশিখা ক্রমে উস্কে দিতে থাকে পাঠ-অনভিজ্ঞদেরও মননে।
এক মহাকাব্যিক আকাঙ্ক্ষার নিরব উচ্ছ্বাস প্রতিটি চরণে ধারণ করে আছে ‘তামাদি’। চর্যাগীতিকা, মঙ্গলকাব্য, লোকগীতিকা, বৈষ্ণব পদাবলিবাহিত বাংলা কাব্যের যে আদি ফল্গুধারা, তারই সার্থক ও আধুনিক উত্তরসূরী সুব্রত।
আটের দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। তাঁর শুরুর দিককার কবিতাগুলো গ্রন্থিত করে যে বইটি বের হয়েছিল, সেটির নাম ‘তনুমধ্যা’।
১৯৯০ সালে প্রকাশিত ‘তনুমধ্যা’ দীর্ঘকাল পড়ে রয়েছিল অপ্রকাশের পর্দার অন্তরালে। সম্প্রতি ‘২৩-এর বইমেলায় পুনঃপ্রকাশের মাধ্যমে আবারও পাঠকের চোখের আলোয় এল ‘তনুমধ্যা’। ‘বৈতরণী’ প্রকাশিত ‘তনুমধ্যা’র নতুন সংস্করণের ভূমিকাংশে কবি আমাদের জানাচ্ছেন— “এ সেই ৮৪-৮৫ সাল। লেখা হচ্ছে বিতিকিচ্ছিরি একটা কিছু, তরুণ শিশুটি আগলাতে পারছে না যাকে, তনুমধ্যা। চেতনা প্রকাশন মারফত বই হতে হতে ৯০। স্বৈরাচার পতনের ৯০। … তিনটি বড় বড় কবিতা, প্রায় একই সাথে লেখা। উঁহু কবিতা নয়, বালখিল্য”।
তনুমধ্যাকে তিনটি পৃথক কবিতা-পাণ্ডুলিপির একটি সংকলন হিসেবে পাঠ করা যেতে পারে। প্রথম পাণ্ডুলিপির নাম ‘তামাদি’। এক মহাকাব্যিক আকাঙ্ক্ষার নিরব উচ্ছ্বাস প্রতিটি চরণে ধারণ করে আছে ‘তামাদি’। চর্যাগীতিকা, মঙ্গলকাব্য, লোকগীতিকা, বৈষ্ণব পদাবলিবাহিত বাংলা কাব্যের যে আদি ফল্গুধারা, তারই সার্থক ও আধুনিক উত্তরসূরী সুব্রত। দশটি সর্গে বিভক্ত প্রধানত আঠারো ও চৌদ্দ মাত্রার স্বভাব-চরণে লিখিত ‘তামাদি’র কিছু ছত্র উদ্ধারযোগ্য—
“ঘাসেদের সর্বনাশ ঘটে গেছে তরশুরও আগে।
পদ্মার শরীরে থান, কে রাখে হিসাব কত দিন।
কাঁঠাল-ছায়ায় এক লুকানো কুটির আর কুটিরে লুকানো
সোনাবউ— আর তার দেড়গজি ঘোমটায় লুকানো হরিণ।
হরিণ! হরিণ! ওরা পশু নয়, তাই
ওদের জিহ্বার ‘খাই’ চোখের চামড়াকে দিয়ে বিসমিল্লা করে”।
বর্তমান নিরীক্ষাপ্রবণতা আর আখ্যানহীনতার এই যুগে মহাকাব্য-সম্ভাবনার দুঃসাহসী প্রয়াস এই ‘তামাদি’। প্রতিটি সর্গ একেকটি দীর্ঘ কবিতা। সংখ্যায় দশ। চতুর্দশ মাত্রায় লিখিত আরও কিছু উজ্জ্বল চরণ উদ্ধারযোগ্য:
“হরেদরে চাপাচাপি করে একই দাবি:
যেথা হতে আয়েছিস সেথা ফিরে যাবি!
মাটি জল অনলের গূঢ় দেহতত্ত্ব
কানে কানে গান গায় কানা হরিদত্ত”।
এর পরের পাণ্ডুলিপির নাম ‘প্রব্রজ্যা’। এতে নানা আকারের ও প্রকারের পাঁচটি কবিতা স্থান পেয়েছে। কবিতাগুলোতে স্মৃতিলগ্নতা, বেড়ে ওঠার বিচিত্র অনুভূতি, প্রেম-রিরংসার রক্তিমাভাস— ইত্যাকার চিত্রকল্পমালা স্থান পেয়েছে।
‘ত্রিভুজ’ নামক পঞ্চম ও শেষ কবিতাটির কয়েকটি চরণ আমরা এখানে পাঠ করে নিতে পারি:
“এখানে দোয়েলবীথি পাপিয়াকানন ছিল মনে পড়ে যেন
ইছামতি অন্নপূর্ণা কর্ণফুলি চতুর ছিনাল
কমল বহন করে কাতর মৃণাল
ভেসে গেছে কল্পকাল
মনে প’ড়ে যায়
মনে পড়ে
হায়”
তনুমধ্যা’র তৃতীয় ও শেষ পাণ্ডুলিপির ‘সাহারা’। সাহারা দু’পর্বে বিভক্ত। আদিপর্ব ও উত্তরপর্ব। প্রতি পর্বে দশটি করে কবিতা। এই পর্বে এসে কবি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পুরাণের নানা অনুষঙ্গ, শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তরণের বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণ, প্রকৃতি আর বস্তুনিচয়ের সাথে গোপন ফিসফাস ইত্যদিতে নিমগ্ন থেকেছেন। কয়েকটা চরণ উদ্ধৃতি দিলে তা স্পষ্ট হয় বোধকরি:
“গল্ রে নদী গল্ রে
এই তো সুযোগ মস্ত
ঐ যে ঐ হস্ত
ঘরে ঘরে বান
রক্তের কানে রক্তের কথা
তরতর বাড়ে রক্তের লতা”
সাহারা’র শেষ কবিতাটির শেষ চারটি চরণ পারস্যের ঐতিহ্যবাহী রুবাইয়ের অন্ত্যমিলরীতিকে অনুসরণ করেছে মনে হলো। রসিক পাঠকগণের সুবিধার্থে এটারও উদ্ধৃতি দিতেই হয়:
“শরৎ শতম্ এই বাতাস থাকুক’
শরৎ শতম্ থাক এই খোলা বুক
মাটি হয়ে, পানি হয়ে, ঘাস হয়ে আর
প্রেমের প্রসূন হয়ে সুখ হ’য়ে সুখ”।।
‘তনুমধ্যা’র পাঠ যেন এক মুখরিত স্মৃতির নিকোনো উঠোনে ফিরে যাওয়া।
তনুমধ্যা
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ
প্রকাশক: বৈতরণী
প্রকাশকাল: ২০২২
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৯৬
দাম: ৩০০টাকা।
বইটি কিনতে:
তনুমধ্যা – বাহিরানা (bahirana.com)