বাহিরানা

তলকুঠুরির কড়চা—ফিওদর দস্তইয়েফ্‌স্কি—নার্সিসিস্টিক সভ্যতার প্রথম বয়ান


বাহিরানা ডেস্ক


একজন ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসের চরিত্র এবং ঘটনাসংগঠনের মাঝে একটা দর্শন উপস্থাপিত করেন, তার দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরেন, তার সমাজ-ঐতিহ্যের একটা বোঝাপড়া থাকে সেখানে। দর্শনের কথাটা এখানে গোলমেলে শোনাতে পারে, তবে অস্ত্বিত্ববাদ একসময় বিশ্বসাহিত্যের অনেকখানি শাসন করেছে, সেটি মাথায় রাখলে আমরা দেখতে পাই আলব্যেয়ার কামুর উপন্যাস আগন্তুক, প্লেগ— তার নিজের অস্তিত্ববাদী দর্শন আর সেই নিরিখে তার দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরেছে। তাতে উপন্যাসের ক্ষতি হয়নি, কারণ সেই দর্শন আরোপিত নয়। জ্যাঁ পল সার্ত্রের ক্ষেত্রে—তার দর্শন—আমাদের লালনের দর্শন যেভাবে গানের মাধ্যমকে ধরে নিজেকে প্রকাশ করেছে তিনিও তার দর্শনকে ফুটিয়ে তুলতে উপন্যাসের সাহায্য নিয়েছেন। এখানে তার তিনখণ্ডের “রোড টু ফ্রিডম” আর বিবমিষার কথা বলা যায়। কিন্তু কাম্যু উপন্যাসই লিখেছেন, আর সেই উপন্যাস নির্মাণে তিনি অস্তিত্ববাদ ব্যবহার করেছেন, যার শেকড় নীৎসে থেকে দস্তয়েফ্‌স্কি পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই তার উপন্যাসের ধারা দস্তইয়েফ্‌স্কি সাহিত্যকর্মের মধ্যে পাওয়া যাবে। এ তো গেল একটি বাদ,দস্তইয়েফ্‌স্কির পরের পুরো আধুনিক সাহিত্যই তার কাছে ঋণী। এমনকী মনোবিশ্লেষণের পিতা ফ্রয়েডের কর্মও তার সাহিত্যের কাছে ঋণী। আর ফ্রয়েডের কর্ম এখনও সাহিত্যে তার শাসন অব্যাহত রেখেছে বলা যায়।

এই বিষয়টির উপর নজর দিলে দেখা যায় উপন্যাসটি আদতে দস্তয়েফ্‌স্কির রাজনৈতিক বয়ান। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না “তলকুঠুরির কড়চা” বহুস্তরীয় উপন্যাস, কোনো একটি দিক দিয়ে এর ভাষ্য নির্মাণ সম্ভব নয়। শুধুমাত্র দস্তইয়েফ্‌স্কি যেভাবে উপন্যাসটির মূল কথকের মনস্তস্ত্বের তলকুঠূরীর দ্বন্দ্ব তুলে এনেছেন সেদিকে তাকালেও বুঝা যেতে পারে বিষয়টি। একে আমরা আমাদের নার্সিসিস্টিক সভ্যতার প্রতিরূপ হিসেবেও পড়তে পারি। এই লেখায় সেই বিন্দুতেই আমরা উপন্যাসটির পাঠ-বিশ্লেষণ করব।

এতোকিছু বলা কারণ হলো ফিওদর দস্তইয়েফ্‌স্কির বহুল আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস “দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যান”-এর মশিউল আলমকৃত অনুবাদ “তলকুঠুরির কড়চা” নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্য। এবং এটা স্পষ্ট করেই বলা যায়, কামুর, ব্যাকেটের সাহিত্য পড়তে অস্তিত্ববাদ নিয়ে কিছু জানাবোঝা থাকলে বুঝতে সুবিধা হয় কিন্তু দস্তইয়েফ্‌স্কি পড়তে এসব কিছুরই জানার প্রয়োজন নেই। জীবনের সামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে রাসকলনিকভের বাড়ির বুড়ি মালকিনকে খুনের পরিকল্পনার অভ্যন্তরের ঢুকে পড়লেই হলো, তখন শুধু জীবন—সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো আর তার দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে ব্যক্তির যুদ্ধ এবং উত্তরণের মাঝে চকিতে নিক্ষেপ করবে। বলা হয় তলকুঠুরির কড়চা’র মধ্যে দস্তইয়েফ্‌স্কি পরবর্তী সব উপন্যাস সূত্রবদ্ধ।

উপন্যাসের কাহিনী এরকম, তলকুঠুরীবাসী লোকটি পিতেরবুর্গের একটি বাড়ির বেসমেন্টে বাস করে। সে একসময় সরকারী চাকরী করতো, এখন তার বয়স চল্লিশ। চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই কুঠুরীতে বসে সে নিজের চরিত্রবিশ্লেষণের মগ্ন, বাকি সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করে তার তৃপ্তি পাওয়া, তার বদরাগ, স্বেচ্ছাচার, আত্মপীড়ণ—এসবই সেই কড়চা থেকে জানতে পারি আমরা।

উপন্যাসটি দুইভাগে বিভক্ত,  প্রথম ভাগের শিরোনাম “তলকুঠুরি” এটি উনিশ শতকের রাশিয়ার ষাট-এর দশক, যখন সে করচা লিখছে। দ্বিতীয় ভাগের শিরোনাম “ভেজা তুষারের কথা” এখানে সে তার অতীত স্মৃতি রোমন্থণ করে। এই অংশের সময়পর্বটি চল্লিশের দশক—তার তারুণ্যের সময়কার ঘটনাগুলি উঠে এসেছে এখানে। তার অফিস, সেখানকার চালচিত্র, বারবণিতা “লিজা”—এসব এর বিষয়বস্তু।

উপন্যাসটি যখন লিখছিলেন তখন দস্তইয়েফ্‌স্কি সদ্য কারাবাস থেকে ফিরেছেন। তার চল্লিশের দশকের আশা-আকাঙ্খা সবই নিরাশায় পর্যবসিত হয়েছে, তিনি অনেকটাই রক্ষণশীল হয়ে উঠেছেন। যে জার শাসনে তিনি জেলে গিয়েছিলেন সেই জারকেই সমীহ করতে শুরু করেছেন। তবে, ভি এল কোমারোভিচ প্রথম সবার সামনে নজরে আনেন, যে, “তলকুঠুরির কড়চা”  চেরনোফ্‌স্কির “কী করতে হবে” নামক উপন্যাসটির উপর নির্ভরশীল বা এর জবাব। চেরনোফ্‌স্কির যৌক্তিক আশাবাদ, সচেতনতার একটা প্যারডি হিসেবেও পড়া যায় বইটিকে। চেরনোফ্‌স্কির “কী করতে হবে” রাশিয়ার পশ্চিমের ধ্যানধারণায় প্রভাবিত স্বাপ্নিক, বিদ্রোহী তরুণ-তরুণীদের রূপচিত্র একটা ইউটোপিয়ার মাধ্যমে তুলে ধরে। কিন্তু দস্তইয়েফ্‌স্কি আমাদের দেখাচ্ছেন সময় গড়াতে গড়াতে ষাটের দশকে এসে তলকুঠুরীবাসী লোকটির মতোই হয়ে উঠেছে চেরনোফ্‌স্কির এককালের সেই বিদ্রোহী তরুণ-তরুণীরা। তারা পশ্চিমের অনুসরণ করতে গিয়ে নিজেদের মাটিকেই ভুলে গিয়ে নিজেদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ তৈরি করেছে।

দস্তয়েফ্‌স্কি Image By Pixabay

এই বিষয়টির উপর নজর দিলে দেখা যায় উপন্যাসটি আদতে দস্তইয়েফ্‌স্কি রাজনৈতিক বয়ান। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না “তলকুঠুরির কড়চা” বহুস্তরীয় উপন্যাস, কোনো একটি দিক দিয়ে এর ভাষ্য নির্মাণ সম্ভব নয়। শুধুমাত্র দস্তয়েফ্‌স্কি যেভাবে উপন্যাসটির মূল কথকের মনস্তস্ত্বের তলকুঠূরীর দ্বন্দ্ব তুলে এনেছেন সেদিকে তাকালেও বুঝা যেতে পারে বিষয়টি। একে আমরা আমাদের নার্সিসিস্টিক সভ্যতার প্রতিরূপ হিসেবেও পড়তে পারি। এই লেখায় সেই বিন্দুতেই আমরা উপন্যাসটির পাঠ-বিশ্লেষণ করব।

মনস্তত্ত্বের অন্যসব দিক তো এসেছেই এমনকি ফ্রয়েডে সূত্রপাত হয়ে অটো কেনবার্গ এবং পরবর্তীতে স্যাম ভ্যাকনিনসহ অন্যরা তাত্ত্বিক ভাষ্য নির্মাণ করেছেন যে নার্সিসিজমের সেটিও উপন্যাসটির মূল চরিত্রের মধ্যে দেখা যায়। অনায়াসেই চরিত্রটিকে কোভার্ট নার্সিসিস্ট বলে আখ্যায়িত করা যায়। এবং তার বুন্ধু জুবরোস্কি—যাকে সে ঘৃণা করে কিন্তু তার দ্বারা অপমানিত হতেও তাকে তার প্রয়োজন—সেই জুবেরোস্কিকে ওভার্ট নার্সিসিস্ট বলে শনাক্ত করা যায়। সে হচ্ছে জার শাসিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতীক আর তাকে ঘিরে রাখা বন্ধু নামীয় চাটুকারেরা হচ্ছে তার গ্রান্ডিওসিটিকে বাঁচিয়ে রাখার রসদ যোগানদানকারী। যা তারা মিথ্যে বানোয়াট প্রশংসার মাধ্যমেই সম্পন্ন করে। কিন্তু তলকুঠুরিবাসী যেহেতু কোভার্ট তাই সে বারেবারেই জুবেরোস্কিকে স্মরণ করিয়ে দেয় তার সবকিছুই মিথ্যে, বানোয়াট, অসততায় পূর্ণ। বিনিময়ে ওভার্ট জুবেরোস্কি তাকে অবজ্ঞার মাধ্যমে চূড়ান্ত অপমান করে। যেভাবে জারের কাছে জনগণ চূড়ান্ত অবজ্ঞার পাত্র।

আরেকটি বিষয় হলো ভালোবাসার অক্ষমতা, উপন্যাসটিতে লিজা ব্যতীত কেউ-ই ভালোবাসতে পারে না, তারা ঊষর এক ক্ষমতার দাস, তারা ভালোবাসাকে যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে চায়। দেখা যেতে পারে, তলকুঠুরীবাসী লিজাকে প্ররোচিত করতে প্রথম সাক্ষাতেই যে ভাষণটি দেয়, তা ছিল পুরোপুরি বুদ্ধিনির্ভর। সে কথা সে নিজেই শেষে পাঠকদের জানায়, যে, সে ভালোবাসাকে ক্ষমতাচর্চা হিসেবে দেখে। সে-ই বলে, এটা ভালোবাসা নয়। কিন্তু লিজা—সেও এখানে সাধারণ কোনো নারী নয়, তাকে অনায়াসেই বর্ডারলাইন (বর্ডারলাইন পার্সনালিটি ডিজঅর্ডার) বলে শনাক্ত করা যায়। এ-বিষয়ে জোয়ান লাস্কারের “নার্সিসিস্টিক/বর্ডারলাইন কাপল” নামে বইটি দেখা যেতে পারে। লিজা তলকুঠুরীবাসীর প্রেমে পড়ে এতে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই প্রেম এক উদ্ধারকর্তার প্রেমে পড়া, যে কীনা তার বাবারই প্রতিমূর্তি। তাকে আমাদের প্রতিনায়ক নিজেই বলে, “শিশুর মতো”। বর্ডালাইন সবসময় এমন একজনকে খুঁজে যে তার জীবনের সব বাস্তবতাকে পরখ করে দেখবে, সব সিদ্ধান্ত নেবে। আর নার্সিসিস্টি চায় দখল (কারণ সে ভালোবাসতে পারে না), বর্ডারলাইন চায় দখলীকৃত হতে। সে নার্সিসিস্টের আয়নার ছবি। দস্তয়েফ্‌স্কি সাইবেরিয়ার নির্বাসন থেকে ফিরে যে নার্সিসিস্ট নায়কের চরিত্র এঁকেছিলেন, আমাদের এই শতাব্দীতে সেটি নার্সিসিস্টিক সভ্যতায় রূপান্তরিত হয়েছে, যার দ্বারে বর্ডারলাইন শিশুর মতো মাথা কুটে মরে, বিনিময়ে অপমান আর যন্ত্রণা ছাড়া কিছুই পায় না।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে দস্তইয়েফ্‌স্কি ফ্রয়েডেরও আগে সুস্পষ্টভাবে নার্সিসিজমকে এঁকেছেন এই উপন্যাসে। ১৯৭০-এর পর ক্লাস্টার-বি পারসনালিটি ডিজঅর্ডারের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করা মনোরোগটির যে ভাষ্য নির্মাণ হয়েছে—এবং এখনও তা চলমান—তা আরো বিষদ আরো হুবহু এবং অভিজ্ঞতার অতলান্তসহ এসেছে তলকুঠুরির কড়চায়।

মশিউল আলম উপন্যাসটির অসাধারণ অনুবাদ করেছেন। শুরুর বাক্য, “আমি লোকটা অসুস্থ…বদ লোক একটা। পিত্তিজ্বালানো লোক। মনে হয়, আমার পেটে সমস্যা আছে।” থেকে শেষ পর‌্যন্ত তিনি দস্তইয়েফ্‌স্কি জটিল-গহন ভাষাকে বাংলায় নতুন জীবন দিয়েছেন। পড়তে পড়তে মনে হয়, অনায়াস, কোনো বাধা-বিপত্তি নেই। এর পেছনের কারণটি মনে হয়, নির্মাণের কর্কশ পরিশ্রমগুলো আড়াল করতে পারা। আর নিজে একজন কথাসাহিত্যিক এবং রাশিয়ায় দীর্ঘদিন বাস করা ও সেইসূত্রে সেদেশের ভাষা-সংস্কৃতিকে প্রতক্ষ্যভাবে জানাটা তাকে বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসটিকে সরাসরি রুশ থেকে বাংলায় সম্ভব করে তুলতে সাহায্য করেছে।

বইটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো অনুবাদক কর্তৃক এর গভীর অভিনিবেশী ভূমিকা আর জোসেফ ফ্রাংক কর্তৃক “তলকুঠুরির কড়চা: একটি বিশ্লেষণ”-এর অনুবাদ, যেগুলো উপন্যাসটির পটভূমি ও এর জটিলতাগুলো ভালোভাবে বুঝতে সহায়তা করে।

ফিওদর দস্তইয়েফ্‌স্কির সাহিত্য পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝার জন্য কিংবা যদি তার একটিমাত্র উপন্যাসও কেউ পড়তে চান তার জন্য “তলকুঠুরির কড়চা” পড়া কর্তব্য।

বইটি সুন্দরভাবে এবং যত্নের সঙ্গে এবং প্রকাশ করেছে মাওলা ব্রাদার্স।

তলকুঠুরির কড়চা
ফিওদর দস্তইয়েফ্‌স্কি
অনুবাদ : মশিউল আলম
প্রকাশনী : মাওলা ব্রাদার্স
প্রকাশকাল : ২০২৩
দাম : ৪৫০ টাকা।

বইটি কিনতে :

তলকুঠুরির কড়চা—ফিওদর দস্তইয়েফ্‌স্কি—অনুবাদ মশিউল আলম – বাহিরানা (bahirana.com)

(Visited 11 times, 1 visits today)

Leave a Comment