বেশির ভাগ মানুষেরই কোন কারণ ছাড়াই অযথা মন খারাপ কিংবা শূন্যতার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলা অনুভূতির সাথে কমবেশি পরিচিতি রয়েছে। হারুকি মুরাকামি তার “নরওয়েজিয়ান উড” বইটিতে পাঠককে এমনই এক বিষণ্ণতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। বইটির নামকরণ করা হয়েছে বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের একটি গানের শিরোনাম থেকে। প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে বইটি জাপান সহ পুরো বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত এই বইটি হারুকি মুরাকামিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে যেখানে তার অন্য উপন্যাসের চরিত্ররা কখনো বাস্তব কখনো পরাবাস্তববাদী আবহ থেকে উঠে আসে কিন্তু “নরওয়েজিয়ান উড” উপন্যাসটিতে তার চরিত্ররা পুরোপুরিই বাস্তব পটভূমি অনুসরণ করে করেছে। তাই বইটি মুরাকামির ভিন্ন আঙ্গিকে কাজ করার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
বাতিঘর থেকে প্রকাশিত বইটির বঙ্গানুবাদ করেছেন আলভী আহমেদ। তার অনুবাদ অসাধারণ, অনুবাদে শব্দ বাছাইয়ে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। হারুকি মুরাকামির লেখা আমার পড়া প্রথম উপন্যাস ছিলো “হিয়ার দ্যা উইন্ড সিং”। “এক্ষেত্রে নরওয়েজিয়ান উড” আমার পড়া লেখকের দ্বিতীয় উপন্যাস।
একটা সময়ে দ্বিতীয় নায়িকা চরিত্র “মিদোরি”র সাথে ওয়াতানাবের পরিচয় হয়। নাওকোর এমন রংচটা জীবনের বিপরীতে মিদোরি’র চরিত্র যেনো বর্ণিল এক উৎসব। তরু ওয়াতানাবে তার নিজের জীবনে উপস্থিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ও স্পষ্টভাষী। ফলে, পড়তে পড়তে যতোই এগুতে থাকি ততই ওয়াতানাবের ভালোবাসার দর্শনের সাথে পরিচয় ঘটে।
উপন্যাসের মূল চরিত্র তরু ওয়াতানাবের বর্ণনায় বইটির গল্প এগুতে থাকে। বইটি পড়তে গিয়ে বারবার মনে হবে যেন জীবন্ত কোনো ডায়েরি। আখ্যানটির প্রেক্ষাপট সত্তরের দশকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তরুণের জীবন। যে কীনা ডর্মে থাকে। বাকী দুই নারী চরিত্র “নাওকো” ও “মিদোরি”, তারা পরস্পরের একদম বিপরীতমুখী স্বভাবের।
পড়তে পড়তে যতোই উপন্যাসের গভীরে গিয়েছি ততই নায়ক “তরু ওয়াতানাব”-এর টানাপোড়েনের সাথে নিজেকেও জড়িয়ে ফেলেছি। বইটি পড়তে গিয়ে অনেকেই হয়তো নিজেদের সাথে নায়ক তরু ওয়াতানাবের মিল খুঁজে পাবেন। ওয়াতানাবের কৈশোরের বন্ধু কিজুকি যার প্রেমিকা “নাওকো” আর সেই সুত্র ধরেই ওয়াতানেবের সাথে নাওকোর পরিচয় ঘটে। কিন্তু কিজুকির হঠাৎ আত্মহত্যা নাওকোর সাথে ওয়াতানেবের ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টির অন্যতম কারন। ওরা দুজনেই কিজুকীর এমনভাবে চলে যাওয়াকে মানতে পারে না।
একটা সময়ে দ্বিতীয় নায়িকা চরিত্র “মিদোরি”র সাথে ওয়াতানাবের পরিচয় হয়। নাওকোর এমন রংচটা জীবনের বিপরীতে মিদোরি’র চরিত্র যেনো বর্ণিল এক উৎসব। তরু ওয়াতানাবে তার নিজের জীবনে উপস্থিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ও স্পষ্টভাষী। ফলে, পড়তে পড়তে যতোই এগুতে থাকি ততই ওয়াতানাবের ভালোবাসার দর্শনের সাথে পরিচয় ঘটে।
উপন্যাসের যে অংশ থেকে রেইকো চরিত্রটি উপস্থিত হয় তখন তার উপস্থিতির উজ্জ্বলতাও মিদোরি’র মতোই একইরকম উজ্জ্বল। রেইকো’র ওয়াতানাবের কাছে চিঠি লেখার মাঝে তার গভীর জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। বইটি রোমান্টিক কিংবা এর মূল উপজীব্য ভালোবাসা হলেও মুরাকামি এখানে ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে না পাওয়াকেই যেনো এর মূল বৈশিষ্ট্যে রূপ দিয়েছেন।
একটা সময়ে ওয়াতানাবে, নাওকো, মিদোরির নিঃসঙ্গতা কিংবা অতৃপ্তি পাঠকের মনকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়। বইটির তিন মূল চরিত্রের মধ্যে নাওকো যেমন কিজুকির মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি, অপরদিকে বিষণ্নতার সময় ওয়াতানাবেকে আঁকড়ে থেকে তাকে খুঁটি হিসেবে নিজের জীবনে পেতে চেয়েছে। অন্যদিকে ওয়াতানাবে নাওকোকে ধরে রাখার জন্য অপেক্ষা করলেও আবার মিদোরিকেও তার জীবন থেকে আলাদা করতে পারে না। তেমনি মিদোরি তার জীবনের উচ্ছ্বলতায় ওয়াতানাবেকে খোঁজে। মুরাকামীয় বর্ণনায় এই তিনজনের টানাপোড়েন যেনো মানুষেরই অসহায়ত্ব এবং তবু নির্ভলশীলতার প্রতিনিধিত্ব করছে। মানুষের দ্বিধাগ্রস্ততা এবং বহুরূপময় কামনার চিত্রকল্প তুলে ধরেছেন তিনি ওয়তানাবে, নাওকো ও মিদোরি’র মাঝে।
বইটিতে জাপানের ৭০ এর দশকের ডানপন্থী পরিবর্তনও উঠে এসেছে ভালোভাবে। অন্যদিকে টোকিও শহরের শরৎ ও শীতকালীন এক মোহনীয় বর্ণনা পাই লেখকের উপস্থাপনায়। পরিবর্তনশীল সময়ের ক্যানভাসে ওয়াতানাবে, নাওকো, মিদোরি ও রেইকো চরিত্রগুলোকে তিনি এমনভাবে চিত্রিত করেছেন যে বইটি শেষ করার পরও তারা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। এদের বিষণ্নতা, অপ্রাপ্তিগুলো সবকিছু নিয়েই পাঠককে ভাবতে বসায়, তাদের হৃদয়ে একইসাথে অপ্রাপ্তিগুলোর কারণ নিয়ে প্রশ্ন জাগে আর চেপে বসে শূন্যতাও ।
আর তাই প্রকাশের এতো বছর পরেও বইটির জনপ্রিয়তা পাঠক ও সমালোচকদের কাছে এখনও আগের মতোই আছে। বইটি এ পর্যন্ত ৫০ টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এই সাফল্য লেখক মুরাকামিকে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিটলসের গানটিও যেমন স্বার্থক। গানের বিখ্যাত দুইটি বাক্য দিয়ে শেষ করি আমার “নরওয়েজিয়ান উড” পাঠ-আলোচনা—
“I once had a girl or should i say, she once had me”
Is not it good? Norwegian Wood!”
নরওয়েজিয়ান উড
লেখক : হারুকি মুরাকামি
অনুবাদ : আলভী আহমেদ
প্রকাশনী : বাতিঘর
প্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর ২০২০
দাম : ৫২৮ টাকা।
বইটি কিনতে হলে :