সরদার শাহনূর
সময়টা আমরা বলতে পারি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিককার কথা। পূর্ব আফ্রিকার জাঞ্জিবার থেকে অদূরে তানজানিয়ার বিভিন্ন স্থানসমূহ হচ্ছে আখ্যানের মূল অঞ্চল। লেখকের শৈশব বিজড়িত মাতৃভূমির বেশিরভাগ এলাকাই ছিলো প্রত্যন্ত ও দুর্গম। ক্রমে এসব এলাকা জুড়েই বিভিন্ন ইউরোপিয়ানদের আধিপত্য বাড়তে থাকে। তারা পূর্ব আফ্রিকার স্থানীয় অনেক জমি-জমা দখল করে নেয়। সহজভাবে বললে একে বলা যায়—পূর্ব আফ্রিকার ঔপনিবেশিক কাল। আফ্রিকার ঔপনিবেশিক কাল সম্পর্কে আপনার সম্যক ধারণা থাকবে যদি জোসেফ কনরাডের “হার্ট অফ ডার্কনেস”-এর সাথে পরিচয় থাকে। অথবা আমরা যারা এডওয়ার্ড সাঈদ পড়েছি।
উপন্যাসে গুরনাহের সুনিপুণ কারিগরি হচ্ছে—ইসলামিক মিথলজি’র সাথে পূর্ব আফ্রিকার ঔপনিবেশিক সময়টাকে একাকার করে ফেলা। এ উন্যাসের আরো চরিত্র হলো— হামিদ, হুসেন, কালাশিঙা। এদের বিভিন্ন উপস্থিতির মাধ্যমে লেখক ঔপনিবেশিক সময়টাকে সূচারুভাবে উপস্থাপন করেছেন। গুরনাহ একজন সোয়াহিলি। আবার উপন্যাসের নায়কও সোয়াহিলি কিন্তু আজিজকে তিনি উপস্থাপন করেছেন আরব হিসেবে।
গুরনাহের “প্যারাডাইস” বা স্বর্গ মূলত এমন একটা সময়ের বাহক। আমরা যদি এর মূল প্লটের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, পূর্ব আফ্রিকার একজন দরিদ্র লোক তার দেনা পরিশোধ করতে না পেরে তারই পরিচিত পাওনাদার আঙ্কেল আজিজের কাছে নিজ সন্তানকে বিনিময় মূল্য হিসেবে দিয়ে দেয়। যাকে দেওয়া হয়েছে সে-ই আমাদের উপন্যাসের মূল চরিত্র “ইউসুফ”। ইউসুফ জানে না তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে আঙ্কেল আজিজের সাথে সে তার বাড়িতে থাকবে। পরবর্তীতে খলিলের মাধ্যমে সে জানতে পারে সে আদতে একজন কৃতদাস। একইভাবে খলিলও এখানে এভাবেই এসেছে। ইউসুফ জানতো আজিজ তার প্রতিবেশি একজন আঙ্কেল, খলিল যাকে বলতো “সাঈদ”। এরপর আমরা দেখি আঙ্কেল আজিজ ইউসুফকে বিশ্বস্ত সহকারী হিসেবে বানিজ্যে নিয়ে যায়। এভাবে ক্রমে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ইউসুফ বেড়ে ওঠে। ট্রেড বা বানিজ্য তো এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এ সম্পর্কে একটু বলতে হয়—আফ্রিকা বিশেষ করে পূর্ব আফ্রিকা ছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সদ্য ঔপনিবেশিক শাসনে আবদ্ধ। তখন বিভিন্ন বেনিয়ারা যেমন— ইউরোপিয়ান, আরব, আফ্রিকান ও ইন্ডিয়ান ক্ষমতাশালী চোরাচালানকারীরা (আমি তাদেরকে চোরাচালানকারীই বলবো, যদিও তারা নিজেদের বলে ট্রেডার) বিনিময়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবসা করতো।
সাঈদ ওরফে আঙ্কেল আজিজ তেমনি একজন ট্রেডার যে কিনা পুঁতির মালা, কাপড়, সুতা ইত্যাদির মাধ্যমে হাতির দাঁত, সোনা, রুপাসহ আরো মুল্যবান জিনিসের বিনিময় করতো। আর এটা সে সংগ্রহ করতো বিভিন্ন ট্রাইবালদের কাছ থেকে যারা এগুলোর প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলো না। ইউসুফের কাছে এই বাণিজ্যের কোনো নৈতিক মূল্য ছিলো না। সে বুঝে উঠতে পারেনি কি হচ্ছে। সে শুধু জানে সে যা করছে আঙ্কেল আজিজের জন্য মন-প্রাণ নিষ্ঠার সাথে করছে। ইউসুফকে সম্যক ধারণার জগতের সন্ধান দেয় খলিল। খলিলের কাছ থেকে ইউসুফ অনেক কিছু জানতে পারে।
উপন্যাসের শেষের দিকে আসে প্রেম। ট্রেড শেষ হলে ইউসুফ আবার ফিরে আসে আঙ্কেল আজিজের বাড়ি। আবার খলিলের সাথে সেই পুরোনো দোকানের দেখাশোনা করে দুজন। বাড়িতে সুন্দর একটা বাগান। ইউসুফ প্রায়ই বাগানের মালির সাথে কাজ করে এবং স্ব-ইচ্ছায় সময় কাটাতে আসে। বাড়ির গৃহকর্ত্রী তার প্রেমে পড়ে। তার নাম জুলেখা। কিন্তু ইউসুফ ভালোবাসে আমিনাকে। খলিল বলেছিলো আমিনা তার বোন, খলিল ও তার বোনকে আঙ্কেল আজিজ দেনা পরিশোধ করতে না পারায় তাদের বাবার কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু পরে ইউসুফ আমিনার বয়ানে জানতে পারে যে আমিনা ইউসুফের পাতানো বোন। খলিলের বাবা আমিনাকে এক কিডন্যাপারের কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলো। যাই হোক, এখন সে সাঈদের মানে আঙ্কেল আজিজের স্ত্রী। জুলেখাও আঙ্কেল আজিজের স্ত্রী। এটা জুলেখার দ্বিতীয় বিয়ে। জুলেখার চামড়ার একদিকে একটু সংক্রমিত। আর এটা তার জন্য অসহ্য যন্ত্রণাময় এক ব্যাধি। আঙ্কেল আজিজ যখন বাণিজ্যের কাজে সারাদিন বাইরে থাকে। বাড়িতে গৃহকত্রী জুলেখা আর আমিনা ইউসুফের গতিবিধি লক্ষ্য করে। পরে জুলেখা বাহানা তৈরি করে যে—ইউসুফ যদি তার সংক্রমিত স্থানে হাত দিয়ে দোয়া করে দেয় তাহলে সে ভালো হয়ে উঠবে। প্রথম একদিন যাওয়ার পর খলিলের বাধা সত্ত্বেও ইউসুফ প্রতিদিন যেতো। মুলত ইউসুফ যেতো আমিনাকে দেখার জন্য। কিন্তু জুলেখা তাকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করতে থাকলো।
শেষে কোরআনের সেই সুরা ইউসুফের মতো ঘঠনা ঘটলো। পরবর্তীতে ইউসুফকে আঙ্কেল আজিজের মোখোমুখি হতে হলো। গল্প শেষ হয়—জার্মান সৈন্য আসে বাড়িতে। খলিল ও ইউসুফ লুকিয়ে পড়ে। তাদের সাথে এই সময়টা কাটানোর মাধ্যমে ইউসুফ নিজেকে আবিষ্কার করে। উপন্যাস শেষে দেখা যায়—যখন সৈন্যরা অনেক দূর চলে যায় তখন ইউসুফ তাদের লক্ষ্য করে দৌড়ে চলে যায় সৈন্য বহরের পিছু পিছু। আমরা জানি না, তারপর কি হয়। অমিমাংসিত এক বাস্তবতার দিকে পূর্ব আফ্রিকার ইতিহাসকেই হয়তো গুরনাহ ইউসুফ আর সৈন্যদের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছেন।
উপন্যাসে গুরনাহের সুনিপুণ কারিগরি হচ্ছে—ইসলামিক মিথলজি’র সাথে পূর্ব আফ্রিকার ঔপনিবেশিক সময়টাকে একাকার করে ফেলা। এ উন্যাসের আরো চরিত্র হলো— হামিদ, হুসেন, কালাশিঙা। এদের বিভিন্ন উপস্থিতির মাধ্যমে লেখক ঔপনিবেশিক সময়টাকে সূচারুভাবে উপস্থাপন করেছেন। গুরনাহ একজন সোয়াহিলি। আবার উপন্যাসের নায়কও সোয়াহিলি কিন্তু আজিজকে তিনি উপস্থাপন করেছেন আরব হিসেবে।
আজিজের সুদৃঢ় চরিত্রের মাধ্যমে আফ্রিকার সমাজে একজন অনন্য বেনিয়া হিসাবে তিনি তাকে স্থাপন করেছেন। আমরা জানি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ হচ্ছেন ইউসুফ। কোরআনের সেই ইউসুফ-জুলেখার কাহিনী কে না জানে? কিন্তু গুরনাহর ইউসুফ একজন কৃতদাস। কিন্তু ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্য সে অনন্য। আমরা এর প্রমাণ পাই বাণিজ্যের সময় বিভিন্ন জটিল সমস্যায় ইউসুফের অলৌকিক সমাধান ক্ষমতার মাধ্যমে। আর তার ব্যক্তিত্বের দেখা পাই আমরা ইউসুফ, জোলেখা আর আমিনার ঘটনায় আঙ্কেল আজিজের সাথে তার বোঝাপড়ার সম্যক জ্ঞানে। তার চরিত্রের মধ্যে একটা আধ্যাত্মিক দিক আছে বটে। পড়তে পড়তে মনে হয় এই আধ্যাত্মিকতার ধারক হচ্ছেন স্বয়ং লেখক আবদুলরাজাক গুরনাহ। বইটি বুকার এবং হুইটব্রেড পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলো।
প্যারাডাইস
লেখক : আবদুলরাজাক গুরনাহ
প্রকাশনী : হামিশ হ্যামিলটন (লন্ডন)
প্রকাশকাল : ১৯৯৪।