গ্রেটা গারউইগের বারবি এবং ক্রিস্টোফার নোলানের ওপেনহেইমার সিনেমা দুইটি প্রকাশের বছর হলিউডের গ্রীষ্মকে অন্য উঁচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। চলচ্চিত্র দু’টি মুক্তির আগেই স্যোশাল মিডিয়ায় ‘বারবেনহেইমার’ হ্যাশট্যাগে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল। প্রথমদিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিস্থিতি থাকলেও মুক্তির পর দেখা গেল দর্শকরা বারবি দেখা শেষ করে ওপেনহেইমার-এর শো’তে ঢুকছে। তবে ‘বারবি’র ক্ষেত্রে নারী দর্শকদের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বেশি। তাদের উচ্ছ্বাস আর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি সমালোচক আর প্রযোজকদের এই বার্তা দিয়েছে যে—শুধুমাত্র নারীদের নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রও ব্লকাবাস্টার হতে পারে, যেমনটা হয়েছিল অনেকবছর আগে ‘মামা মিয়ার’ (২০০৮) ক্ষেত্রে। কাকতালীয় হচ্ছে ‘মেরিল স্ট্রিপ’ অভিনীত সেই ছবিটিও ক্রিস্টোফার নোলানের ‘দ্য ডার্ক নাইট’-এর সাথে একযোগে মুক্তি পেয়েছিল। ‘মামা মিয়া’ ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিল সেসময়। আর ইতোমধ্যেই গ্রেটা গারউইগ সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসার পাশাপাশি ১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে নারী পরিচালকদের মাঝে সর্বকালের সেরা ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রের খেতাব অর্জন করে নিয়েছেন। আয়ের দিক থেকেও বারবি এই বছরের এক নাম্বার স্থানে আছে। চলচ্চিত্রটির অসাধারণ গল্প লিখেছেন গ্রেটা গারউইগ আর নোয়াহ বৌমবাখ।
মারগট রবি Image by People
বারবি সেখানে শাশা’র (আরিয়ানা গ্রিনব্লাট) কাছে জানতে পারে তার পারফেক্ট সৌন্দর্য আসলে নারীবাদকে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। শাশা বারবিকে ফ্যাসিস্ট বলে ঘোষণা করে। আবার ম্যাটেল এইচ কিউ (বারবি তৈরির প্রতিষ্ঠান) ‘উইল ফেরেল’ তাকে বক্সের মধ্যে ফিরিয়ে নিতে চায়। এসব ঘটনারাশিতে মারগট রবি আর রায়ান গসলিং-এর অসাধারণ অভিনয় এবং গোলাপী রঙের বারবিল্যান্ডের চমৎকার নির্মাণ চলচ্চিত্রটিকে ভিন্ন এক মাত্র দিয়েছে।
গল্পটি এরকম, বারবিল্যান্ড নামে এক জায়গা আছে, যেখানে বারবি ডলদের বসবাস। প্রত্যেক বারবিই নিজের নিজের কাজ নিয়ে সুখী জীবন যাপন করে সেখানে। তাদের নিজস্ব ঘর, আনন্দোল্লাসের জন্য ক্লাব, সি-বিচ সবই আছে। সেখানে আবার প্রত্যেক বারবির একজন করে ‘কেন’ আছে। এই আপাত সুখী, আশাবাদী বারবিদের মাঝেই একজন বারবি হলো সিনেমার মূল চরিত্র (মারগট রবি)। যে হঠাৎ একদিন তার অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। মৃত্যু, উদ্বিগ্নতা, জীবনের ক্ষয় এবং উদ্দেশ্য নিয়ে তার ভাবনা জাগে। ফলে, সে তার অন্য সুবিধাবাদী প্রতিবেশীদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। আর একদিন সে বেড়িয়ে পড়ে বাস্তবের পৃথিবীকে আবিষ্কার করতে। এই যাত্রায় তার সঙ্গী হয় ‘কেন’ (রায়ান গসলিং), সেও জীবনের অর্থ আর বাস্তবের পৃথিবীকে জানতে চায়। এরপর শুরু হয় তাদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার। বাস্তবের পৃথিবীতে তারা নিজেদের ভিন্নভাবে খুঁজে পায়, সৌন্দর্য আর তার আড়ালে শোষণ, পুরুষতন্ত্র, নারীদের পণ্যায়ন— সবকিছুরই দেখা পায় তারা। আত্ম উন্মোচনের মাঝে বারবি তার দুর্বলতা আর সক্ষমতাকে আবিষ্কার করে। এরমাঝে কেন-এর সাথে তার প্রেমের সম্পর্কও গড়ে ওঠে। তখন তারা বন্ধুত্ব, ভালোবাসার প্রকৃত অর্থকেও জানতে পারে।
রায়ান গসলিং Image by Digital Spy
এখানে বলা যায়, বারবির চেয়ে কেন অনেকটাই নিজেতে নিবদ্ধ, একটা নিজস্ব বোধ আছে আছে নিজেকে নিয়ে। সম্পূর্ণ একজন মানুষ হয়ে উঠতে যেটা সবচেয়ে দরকারী। সে নিজের পরিষ্কার একটা ধারণা তৈরি করতে চায়। নতুন পৃথিবীতে সে পুরুষদের আধিপত্য দেখে ফেলেছে। আবার নিজের এবং তার চারপাশের সবকিছু নিয়ে অগ্রসর চিন্তাভাবনার কারণে একসময় যেন সে-ই চলচ্চিত্রের সব আলো টেনে নিতে চায়। পরিচালকও ভূমিকা রেখেছেন এখানে, সিনেমার বেশিরভাগ সাউন্ডট্রাকই ‘কেন’-কে কেন্দ্র করে। কিন্তু বারবি চরিত্রে মারগট রবি দারুণ খাপ খেয়েছে। গোলাপী রঙের এক রূপকথার মতো জায়গায় যেখানে বারবিরা যা ইচ্ছা তাই হতে পারে, এর ঠিক বিপরীতে বাস্তবের পৃথিবীতে এসে পড়ে সে। যেখানে পদে পদে নারীদের আটকে রাখা হয়। বারবি সেখানে শাশা’র (আরিয়ানা গ্রিনব্লাট) কাছে জানতে পারে তার পারফেক্ট সৌন্দর্য আসলে নারীবাদকে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। শাশা বারবিকে ফ্যাসিস্ট বলে ঘোষণা করে। আবার ম্যাটেল এইচ কিউ (বারবি তৈরির প্রতিষ্ঠান) ‘উইল ফেরেল’ তাকে বক্সের মধ্যে ফিরিয়ে নিতে চায়। এসব ঘটনারাশিতে মারগট রবি আর রায়ান গসলিং-এর অসাধারণ অভিনয় এবং গোলাপী রঙের বারবিল্যান্ডের চমৎকার নির্মাণ চলচ্চিত্রটিকে ভিন্ন এক মাত্র দিয়েছে।
গ্রেটা গারউইগের বারবি’র গল্প নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে, সেইসাথে নারীর সাথে ঘটা অসাম্য আর তাদের ঘিরে গড়ে উঠা পুঁজির সুযোগসন্ধানী দর্শন নিয়ে সোচ্চার। হলিউউডে আরেক নারী পরিচালক জেন ক্যাম্পিয়নের দ্য পাওয়ার অব দ্য ডগ (২০২১) শিরোনামের অসাধারণ চলচ্চিত্রে আমরা দেখেছিলাম প্রচলিত মাচো ম্যান বনাব বুদ্ধিমান পুরুষের (যার সংবেদনশীলতা ও কমনীয়তাকে নারীসুলভ বলে মনে হয়) দ্বন্দ্বের অনবদ্য রূপায়ণ। আর গ্রেটা গারউইগের বারবিতে দেখা যায় সুখী এক পুতুলকে, যে মাচো ম্যানের মতোই সবকিছু কেন আছে তা নিয়ে প্রশ্ন করে না, কিন্তু তার চেয়ে পদবলে ছোট পুরুষ পুতুল “কেন” প্রশ্ন করে, কেন? আর এই “কেন”এমনই এক বুদ্ধিদীপ্ত রোগ যা, মাচো ম্যানকেও (জেন ক্যাম্পিয়নের মাচো ম্যান গ্রেটা গারউইগের বারবি, কারণ তারা দুইজনই সমাজের চাপিয়ে দেওয়া আদর্শকে মান্য করে চলে) হারিয়ে দেয়। দুই চলচ্চিত্রেই আমরা বুদ্ধির জয় দেখেছি। যা মূলধারার চলচ্চিত্রে দুই নারী পরিচালকের মাধ্যমে পুরুষতন্ত্রের সংকট তুলে ধরে নারীদের ক্ষমতায়নের প্রবল ইঙ্গিই দিচ্ছে। দুইটি চলচ্চিত্রেই পরিচালকদে বুদ্ধিকে প্রাধান্য দিয়ে পাওয়া জয়ের উপর যে নির্ভরতা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেরকম শারীরিক শক্তির প্রাধান্য দিয়ে নারীকে অবদমিত করে রাখে—সেটি তার বিরুদ্ধে সফল প্রতিবাদ।
গ্রেটা গারউইগ নারী যে এই সমাজে এক বস্তু, এইদিকটিতে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। তবে ম্যাটেলের তৈরি বারবি ডলের নিজস্ব ফ্যানবেইজ দর্শকবৃন্দকে গ্রেটা গারউইগ বেশি উত্যক্ত করতে চাননি সেটা বোঝা শক্ত নয়। ছবিতে জনপ্রিয় সংস্কৃতির অনেক রেফারেন্সসহ অন্য অনেক চলচ্চিত্রের প্রভাব রয়েছে, যেমন, এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড, মেট্রিক্স চলচ্চিত্রে বিখ্যাত রেড পিল ব্লু পিল ধারণা, উইজার্ড অব ওজ, গডফাদার, টয় স্টোরি। তবে সব মিলিয়ে বারবি নিজেকে আবিষ্কারের এক অসাধারণ গল্পই বলে আমাদেরকে, যেখানে আমরা নিজেদেরকেও দেখতে পাই। গারডিয়ান চলচ্চিত্রটি নিয়ে তাদের রিভিউয়ে লিখেছে, গারউইগ আর মারগট রবি প্রোডাকশন ডিজাইনার আর সংগীতকারদের নিয়ে নিশ্চিত করেছেন, “সবকিছুই অসাধারণ, এমনকি যখন তা নয় তখনও!”।
বারবি গ্রেটা গারউইগ সময় : ২ ঘন্টা প্রকাশাল : ২০২৩।