বাহিরানা

মাইয়াডাগা (Meiyazhagan)—আত্মআবিষ্কারের এক স্মৃতিমেদুর জার্নি


মামুনুর রশিদ তানিম


‘৯৬’ বানিয়ে বেশ পরিচিত হওয়া তামিল পরিচালক সি. প্রেম কুমারের নতুন সিনেমা ‘মাইয়াডাগা’। ম্যাচিউর এবং মেডিটেটিভ সিনেমা। মন আর্দ্র করার মতো। আত্মীয়তা, আত্ম-আবিষ্কার নিয়ে হৃদয় নিংড়ানো জার্নি। প্রেম কুমারের দ্বিতীয় সিনেমা ‘জানু’, প্রথম সিনেমা ‘৯৬’— এরই রিমেক। একটা পপুলিস্ট রিমেক। বলা যায়, ৬ বছর পর নিজের বৃত্তে ফিরলেন এটা দিয়েই। প্রেম কুমারের সিনেমায় ছোট ছোট নানান স্মৃতি, টুলস; আপাতদৃষ্টিতে যা অপাংক্তেয় কিন্তু সিনেমার ন্যারেটিভকে ভারী করতে এবং মূল কোন চরিত্রকে সুগভীর ও আবেগময় আর্ক দিতে অপরিহার্য—গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সিনেমায় যেমন আছে, ২২ বছর আগের সাইকেল!

সাথে প্রেম কুমার নিয়েছেন তামিলের দুজন ‘এ’ লিস্টের অভিনেতাকে৷ অরভিন্দ স্বামী এবং কার্থি৷ এমন পুরোদস্তুর ড্রামা গল্পে, এই কাস্টিং আরো ভালোলাগা যোগ করে৷ কারণ এই দুজনের বাণিজ্যিক আবেদনটা থাকা সত্ত্বেও, হিরোইজমে চুপসে যাওয়া কেউ নন তারা। দর্শকের কাছেও ওই গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ায় বাণিজ্যিক ধারাতেই অনবদ্য অভিনেতা হিসেবে দুজনের পরিচিতি দাঁড়িয়েছে। কার্থির চরিত্রটাই ওভাবে চরিত্রায়ন করা হয়েছে যে, সিনগুলোয় ওর আলাদা একটা প্রভাব থাকবে।

‘মাইয়াডাগা’র গল্পের কেন্দ্র আবর্তিত হয় অরুলকে ঘিরে। তার বয়স যখন ১৮, তখন জমি নিয়ে পারিবারিক বিরোধের জের ধরে সে আর তার পরিবার চলে যায় মাদ্রাসে, জন্মস্থানের স্মৃতি আর শেকড়ের সেই মায়া ভোলার চেষ্টায়। ২২ বছর পর, স্মৃতিতাড়িত অরুল দোনোমোনো নিয়ে আরেকবার আসে নিজ জন্মস্থানে আসে তার সবচেয়ে ছোট কাজিনের বিয়েতে। আসতে বাধ্য হয় কারণ, বোন তাকে ছাড়া বিয়ে করবে না। আর বিয়ের আসরেই তার পরিচয় হয় একজনের সাথে, স্মৃতির অতল থেকে কোনভাবেই যাকে সে মনে করতে পারে না। কিন্তু সেই ছেলে, ভাইয়া ভাইয়া করতে করতে তার পিছু ছাড়তে চায় না। অরুলের ছোটবেলাকার প্রত্যেকটা ঘটনা তার মনে আছে হুবুহু। অরুলের পুরানো সেই জীর্ণ সাইকেল, ৮ বছর ব্যবহারের পর অরুলরা যখন গ্রাম ছেড়ে যাবে তখন অরুল বলেছিল তার বাবাকে, ওই সাইকেল কাউকে দিয়ে দিতে। অরুলের বাবা ওই ছেলেটাকেই দেয়, যেটা অরুল জানতো না। কিন্তু ওই এক সাইকেল জীবন বদলে দিয়েছিল সেই ছেলের৷ অরুলের ফেরার বাস মিস হয়। আর সেই সুযোগে এই প্রাণোচ্ছল, মানুষের প্রতি অসীম মায়া রাখা ছেলেটা অরুলকে নিয়ে যায় ২২ বছর আগের স্মৃতির, সবচেয়ে আবেগঘন পাতায়৷ যেই স্মৃতি আর যেই ছেলের অস্তিত্ব সম্পর্কে অরুল মনে করতে পারে না কিছুই।

আত্মীয়ের মাঝে খারাপ তো আছে অবশ্যই। আত্মীয়তার সম্পর্ক যে দিনেদিনে বৈষয়িক হয়ে উঠছে বা সবসময়ই যে সেটায়, বৈষয়িকতা ছিল তা তো অবশ্যই। কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না এবং আত্মীয়তাবোধ যে একেবারে শেকড়ে যুক্ত সেটাও অস্বীকার করা যায় না। আত্মার আত্মীয় যে কেউ হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু ওতে ঠিকই ‘আত্মীয়’ শব্দটা আছে। তাই খারাপের পরও আস্থাটা ওই নিজের মানুষেরই উপরই করতে হয় আরকি। ওটাকেই কেন্দ্রে রেখেছে এই সিনেমা। সাথে অরুলের আত্মসন্ধানের একটা জার্নি। ক্ষমা, মানবিকতা, সম্পর্ক সবই এতে মিশে যায় ওতপ্রোতভাবে। প্রেম কুমার, একদমই বাস্তবিক আর শেকড় অক্ষুণ্ণ রেখে লিখেছেন চিত্রনাট্যটা। সিনের সেটিং, বর্ণনা ও সংলাপে একটা নির্ভেজাল ব্যাপার আছে। ওটাই সিনেমাকে গ্রাউন্ডেড জায়গাটা দিয়েছে। একারণে, আবেগে ভারী সিনগুলোও অনুনাদি হয়ে নাড়া দিতে পারে দর্শককে। একদমই উপমহাদেশীয় সেন্টিমেন্ট। তাই ওই মমত্ববোধটাকে সহজেই ছেঁকে নেওয়া যায়। আবেগতাড়িত হওয়া যায়।

সাথে প্রেম কুমার নিয়েছেন তামিলের দুজন ‘এ’ লিস্টের অভিনেতাকে৷ অরভিন্দ স্বামী এবং কার্থি৷ এমন পুরোদস্তুর ড্রামা গল্পে, এই কাস্টিং আরো ভালোলাগা যোগ করে৷ কারণ এই দুজনের বাণিজ্যিক আবেদনটা থাকা সত্ত্বেও, হিরোইজমে চুপসে যাওয়া কেউ নন তারা। দর্শকের কাছেও ওই গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ায় বাণিজ্যিক ধারাতেই অনবদ্য অভিনেতা হিসেবে দুজনের পরিচিতি দাঁড়িয়েছে। কার্থির চরিত্রটাই ওভাবে চরিত্রায়ন করা হয়েছে যে, সিনগুলোয় ওর আলাদা একটা প্রভাব থাকবে। এবং ‘শো স্টিল’ করার সুযোগও তার সবচেয়ে বেশি থাকবে। আর কার্থি এই গল্পপ্রিয়, সারল্যভরা, আশাবাদী, স্মৃতিমেদুরতায় ভোগা চরিত্রটি রূপায়নও করেছেন নিজের মতো। স্বতঃস্ফূর্ততায় পরিপূর্ণ। কার্থি হতে পেরেছে এমন একটি আশাবাদী চরিত্র, যাকে যেকোন মানুষ পাশে চাইতে পারে বন্ধুরূপে। অরভিন্দ স্বামীর চরিত্রের নানা আবদ্ধ অনুভূতিকে প্রকাশে, কার্থির চরিত্র কাজ করে অনুঘটক হিসেবে। আর সেটা এত মসৃণভাবে সম্ভব হয়েছে অরুল চরিত্রে অরবিন্দ স্বামীর অন্তর্মুখী, আত্মসচেতন আর অনড় পারফর্ম্যান্সের জন্য। তাকে আবেগের দিক থেকে প্লবতায় এনেছে কার্থি, কিন্তু সেটা এতটা বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে আবেগগুলো কুঠুরিতে আঁটকে রাখবার ক্ষেত্রে অরভিন্দ স্বামীর নিয়ন্ত্রিত অভিনয়ের জন্য। বিপরীতমুখী স্বভাবের দুই চরিত্রের এমন ‘বাডি-ড্রামা’ ঘরানার ডায়নামিকটা চেনা পরিচিত৷ কিন্তু দুই অভিনেতার রসায়নে সেটা গভীরতার জায়গাটা পেয়েছে। আর এই ফর্মাটা প্রেম কুমার ‘৯৬’—এও সফলভাবে প্রয়োগ করেছিলেন, যেখানে মূল একটি চরিত্রে একজন দ্বান্দ্বিক ও ভঙ্গুর অনুভূতির ব্যক্তি থাকে। কোন একটা উদযাপনের মাঝখানেই তার শূন্যতা উপলব্ধি করে দর্শক। আর আরেকটা মূল চরিত্র, এই গোটা স্পেস থেকেই তাকে উদ্ধারে আসে ত্রাণকর্তার রূপে এবং একটা আদরমাখা জার্নিতে নিয়ে যায়। গল্পবলার ক্ষেত্রে এই ফরম্যাট’টাই তার বিষয়বস্তু ও স্টাইল হিসেবে ধরা যায়।

প্রেম কুমারের ভিজ্যুয়াল স্মৃতিমেদুর স্বভাব আর আবেগে পরিপূর্ণ। পরিচালনায় আসার আগে সিনেমাটোগ্রাফিতেই ছিলেন। তাই গল্পের মেজাজ ধরে সঠিক ভিজ্যুয়াল ট্রিটমেন্ট দেওয়াতে তিনি সিদ্ধহস্ত। ফ্রেম স্ট্যাটিক রেখে চরিত্রকে মুভ করিয়ে মুহূর্তটা ধরার; আবার, ফ্রেমকে চলমান রেখে অভিনেতাদের ছোটখাটো স্থির জেশ্চারগুলোকে একদম কাছ থেকে ধরে ইমোশন জাগানোর কাজটায় দক্ষ তিনি। আবহটাও সুন্দর দাঁড় করান। সম্পাদনায় দ্রুত কাট না করে শটগুলোকে লিঙ্গার করতে দেন। এতে আবেশ তৈরি হয়। কিন্তু সেটা আরেকটু কম করলে, দৈর্ঘ্যটাও বরাবর জায়গায় আসতো। ড্রামাও আরো প্রগাঢ় হতো, শুরুর দিকে গল্পের মেজাজে একটু বেশি সময়ক্ষেপণ না করে। তবে, ‘আনবে শিভাম’ (২০০৩) থেকে অনুপ্রেরিত (যেটি আবার জন হিউসের ক্লাসিক ‘প্লেইনস ট্রেইনস এন্ড অটোমোবাইলস’ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিল), ‘মাইয়াডাগা’ অবশ্যই, প্রেম কুমারের আরো পরিশীলিত ফিল্মমেকিংয়ের উদাহারণ!

(সিনেমাটা প্রযোজনা করেছেন আবার সুরিয়া ও জ্যোতিকা! তাদের সেন্সিবলিটি প্রশংসাযোগ্য।)

(Visited 32 times, 1 visits today)

Leave a Comment