জাভেদ হুসেনের অনুবাদকর্ম নিয়ে বাড়তি কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। মার্কসবাদ থেকে শুরু করে উর্দু সাহিত্য সব জায়গা থেকেই বহুমূল্যবান সৃষ্টিকর্ম বাংলা ভাষায় যুক্ত করে চলেছেন তিনি। “সন্ত কবিরের দোহা” তাঁর সাম্প্রতিক বই। বইটি শুধু অনুবাদকর্মের জন্যেই নয়, এর সমৃদ্ধ ভূমিকা এবং বর্তমানে সন্ত কবিরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে “কবির আজকে কেন” লেখাটির জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ।
মৃত্যুর শতবছর পর কবিরের দোহাগুলো সংরক্ষিত হয়েছিল, তার আগে সেগুলোকে ধর্মরাজনীতির যাতাকলে পিষ্ট শ্রমজীবী মানুষেরাই মুখে মুখে ছড়িয়ে দিয়েছিল তখনকার ভারতবর্ষের বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে। এভাবে মানুষের স্মৃতি-শ্রুতিতে কবিতার সংরক্ষণ সময়ের নিগড় ছাড়িয়ে টিকে থাকাকেই দৃশ্যমান করে। কিন্তু কী ছিল সেই দোহাগুলোয় কিংবা কেনইবা কবির এগুলো রচনা করেছিলেন? ধর্মরাজনীতির বিরুদ্ধাচরণই তাঁর লেখার মূল কারণ, যেটিও কীনা রাজনীতি— গরীব আর শোষিতের পক্ষে দাঁড়িয়ে।
ভূমিকা অংশে অনুবাদক জানাচ্ছেন, কবিরের জন্মস্থান বেনারসের মাহাত্ম এবং সেখানে তাঁর বেড়ে ওঠার কথা। বেনারস তখনকার সময়ে জ্ঞানী আর ভাবুকদের এক মহামিলনস্থলে পরিণত হয়েছিল। একসময়ের প্যারিস, বাগদাদ আর আলেকজান্দ্রিয়াও সাহিত্যিক, দার্শনিক আর বিভিন্নধারার সৃষ্টিশীলদের জন্যে তাদের দরোজা খুলে দিয়েছিল। তবে বেনারস নিয়ে কমই জানি আমরা, ভূমিকাটি এই অভাব কিছুটা মেটাতে পারবে। এই জানাটা প্রয়োজনীয় কেননা, কী পটভূমিতে কবিরের ভেতর ভিন্নমতের দার্শনিকতা জেগে উঠেছিল সেটা তখনকার বেনারসকে জানলে বুঝতে সুবিধা হয়। যেকোনো সৃষ্টকর্মের সাথেই পটভূমি আর তার কালের ইতিহাস নিবিড়ভাবে জড়িত।
ভূমিকার সাথে “কবীর আজকে কেন” নামে যে বিশদ তথ্যসম্মৃদ্ধ রচনাটি যুক্ত করেছেন, সেটি বর্তমানে কবিরের প্রাসঙ্গিকতাকে আরো জোরদার করে। তাঁর দোহা কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই আশ্চর্য ইতিহাসও জানিয়েছেন তিনি— যেটি কীনা কোনো না কোনোভাবে সব মহৎ কবিরই নিয়তি। মৃত্যুর শতবছর পর কবিরের দোহাগুলো সংরক্ষিত হয়েছিল, তার আগে সেগুলোকে ধর্মরাজনীতির যাতাকলে পিষ্ট শ্রমজীবী মানুষেরাই মুখে মুখে ছড়িয়ে দিয়েছিল তখনকার ভারতবর্ষের বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে। এভাবে মানুষের স্মৃতি-শ্রুতিতে কবিতার সংরক্ষণ সময়ের নিগড় ছাড়িয়ে টিকে থাকাকেই দৃশ্যমান করে। কিন্তু কী ছিল সেই দোহাগুলোয় কিংবা কেনইবা কবির এগুলো রচনা করেছিলেন? ধর্মরাজনীতির বিরুদ্ধাচরণই তাঁর লেখার মূল কারণ, যেটিও কীনা রাজনীতি— গরীব আর শোষিতের পক্ষে দাঁড়িয়ে। তাই কবির আজও প্রাসঙ্গিক, যেহেতু সেই কারণগুলো আজও বর্তমান।
জাভেদ হুসেনের অনুবাদে দোহাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় কবির হয়তো বাংলা ভাষাতেই সৃষ্টি করেছিলেন এগুলো। সাবলীল আর স্বচ্ছন্দ ভাষায় মূল ভাবকে ধরতে পারার জন্যেই এরকম হয়েছে। বইটি থেকে মূলের সাথে কয়েকটি দোহার বাংলা অনুবাদ দেখে নিতে পারি আমরা:
মূল
“লালি মেরে লাল কি জিত দেখো তিত লাল
লালি দেখন ম্যায় গ্যায়ি ম্যায় ভি হো গ্যায়ি লাল”
অনুবাদ
“আমার প্রিয়র লাল রং, যেদিকে তাকাই সব লাল
সেই রং দেখতে গিয়ে আমিও রাঙা হলাম”
মূল
“বিরহা জলন্তি ম্যায় ফিরুঁ জলত জলহারি জাউঁ
মো দেখয়া জলহারি জ্বলে সন্তোঁ কাহাঁ বুঝাউঁ”
অনুবাদ
“বিরহে জ্বলে ঘুরে মরি, নেভাতে যাই নদীর কাছে
আমায় দেখে নদীই জ্বলে, সন্ত, বলো এ আগুন কোথায় নেভাই”
এমন চমৎকার সব রূপকল্পে কবির তার সমাজ, প্রেম, বিদ্রোহ আর মরমিয়া ভাবনার বিস্তার ঘটিয়েছিলেন, যা দেশে দেশে আজও অত্যাচারিত আর
দু:খী মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছে। প্রেম আর বিরহকে তিনি মানবের হৃদয়ে থাকা মহাকালের মাঝে জেনেছিলেন:
“হয় বিরহীকে দাও মৃত্যু, নয় দেখা দাও
অষ্টপ্রহরের এই দহন আর সহ্য হয় না”
(সন্ত কবীরের দোহা)
এই বিরহ একজন আশেকের সাথে তার মাশুকের বিচ্ছেদ থেকে সৃষ্ট, জগৎ প্রতিনিয়ত ভেদ-বাধা সৃষ্টি করছে সেই মিলনের পথে। সন্ত কবির সেই ভেদ ঘোচাতে চান প্রেমের মুক্তিতে।
বইটি পাঠকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক।
সন্ত কবিরের দোহা
অনুবাদ: জাভেদ হুসেন
প্রকাশক: বাতিঘর
দাম: ২৮০ টাকা।