বাহিরানা ডেস্ক
ভারতে থেকে মওলানা ভাসানী যদি কথা বলেন তাহলে অন্য নেতাদের কথাগুলো গৌণ হয়ে যাবে। গণমাধ্যমে এবং রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো ভাসানীকেই গুরুত্ব দেবে। এসব কারণেও ভারত সরকার মওলানা ভাসানীকে প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি।
(আমি ও আমার মওলানা ভাসানী, সৌমিত্র দস্তিদার)
উপরের উদ্বিৃতিটি আমাদের আলোচ্য বইয়ের নয়, তবে আবদুল হামিদ খান ভাসানী মুক্তিযুদ্ধের সময় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন এবং ভারতে তার অবস্থান কতটা ভালো বা খারাপ ফল বয়ে এনেছিল, তার একটি ইঙ্গিতমূলক ধারণা এতে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মওলানা ভাসানী এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হবার পর থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্তও একই কথা খাটে। এর সূত্রপাত ব্রিটিশ ভারতে, কেননা তখন আওয়ামী মুসলিম লীগের (পরবর্তীতে যা আওয়ামীলীগে রূপান্তরিত হয়) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ভাসানী। তার সাদামাটা জীবনের মতোই বিভিন্ন জটিল রানৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণগুলো ছিল জটিলতাহীন, মোক্ষম বলা যায় যাকে। দেশের আর জনগণের স্বার্থের প্রাধান্যই ছিল তার রাজনীতি। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভারতে অবস্থান নিয়ে সব সময়েই একটা কৌতূহল ছিল রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী থেকে সাধারণ মানুষের পরিসরে।
এ এক অসামান্য বক্তব্য, কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল কী অন্যরকম হতে পারত যদি ভাসানী ভারতীয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকতে পারতেন? আশা করি সাইফুল ইসলামের এই একটা বাক্যে আমরা আমাদের উত্তর দাঁড় করাতে পারব। তার কাছ থেকেই জানা যায়, মওলানার একা হয়ে যাওয়ার কথা, এবং সংগঠনের অভাবের কথা। কেননা কলকাতায় অবস্থানকারী আওয়ামিলীগ নেতৃত্ব পাঁচ উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। আর তার ন্যাপ দেশে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ছিল।
কী করেছিলেন সেখানে তিনি? যেহেতু বিভিন্নজনের লেখায় আমরা জানতে পারি তিনি মুক্তিযুদ্ধের আগে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন এবং সেই লক্ষ্যে লন্ডনে বিপ্লবী অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে ভারত হয়ে লন্ডন যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভারতে কীভাবে পৌঁছেছিলেন, এবং সেখানে তিনি কী কী করেছিলেন তার সবিস্তার বর্ণনা আমরা পাই তার সফরসঙ্গী তৎকালীন ন্যাপ (মোজফ্ফর) নেতা সাইফুল ইসলামের “স্বাধীনতা ভারত ভাসানী” বইটিতে।
বলা যায় ভাসানীকে নিয়ে অনেক প্রশ্নেরই বিশ্বাসযোগ্য উত্তর আমরা পাই আমাদের আলোচ্য বইটিতে। আমরা জানতে পারি পাকিস্তানি বাহিনী ভাসানীর টাঙাইলের সন্তোষের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার সময় তিনি “বিন্যাফৈর” নামক গ্রামে অবস্থান করছিলেন। পরে সেখানেও হানাদার বাহিনী অগ্রসর হলে তিনি কৃষকের বেশে আরেকটি গ্রামে যান এবং সাইফু্ল ইসলামকে ভ্রমণসঙ্গী করে যমুনা নদী ধরে আসাম দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। যদিও সেখানে প্রবেশে তিনি বাধার মুখে পড়েন। তাকে বলা হয়েছিল— আওয়ামীলীগ ছাড়া অন্য কাউকে ঢুকতে দেওয়ার অর্ডার নেই। পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মঈনুল হকের হস্তক্ষেপে তিনি সেখানে প্রবেশ করেন, তাও ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে ফোনে অনুমতি নিতে হয়েছিল। আসাম থেকে কোলকাতা, কোচবিহার, দেরাদুন, দিল্লীতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া—বিচিত্রসব স্থানে কেটেছে তার ভারতে অবস্থানপর্ব।
ভারতে অবস্থান কালে তাকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয় উত্থাপিত হতে থাকে বিশেষ করে তার মৌন হয়ে যাওয়া নিয়ে। সেখানকার সরকার তাকে গৃহবন্দী করেছে এরকম অভিযোগও উঠতে থাকে। আবার, মুক্তিযুদ্ধের পাঁচদলীয় উপদেষ্টা কমিটিতে তার ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ নিয়ে প্রশ্নগুলোও মাথাচাড়া দিয়েছিল। তার একটা নির্ভরযোগ্য জবাব এই বইটি আমাদের সরবরাহ করে। তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহবন্দী করে রাখার একটা জবাব আমরা পাই সাইফুল ইসলামের কাছ থেকে, তিনি আমাদের জানান, ভাসানী, “উত্তর ভারতে ছিলেন মুক্ত, কিন্তু পূর্ব ভারতে ছিলেন নিয়ন্ত্রিত।” এ এক অসামান্য বক্তব্য, কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল কী অন্যরকম হতে পারত যদি ভাসানী ভারতীয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকতে পারতেন? আশা করি সাইফুল ইসলামের এই একটা বাক্যে আমরা আমাদের উত্তর দাঁড় করাতে পারব। তার কাছ থেকেই জানা যায়, মওলানার একা হয়ে যাওয়ার কথা, এবং সংগঠনের অভাবের কথা। কেননা কলকাতায় অবস্থানকারী আওয়ামিলীগ নেতৃত্ব পাঁচ উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। আর তার ন্যাপ দেশে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ছিল। এসব তাকে সংগঠনহীন করে তুলেছিল। তিনি সন্দেহপূর্ণ একটা মানসিক পরিস্থিতিও মোকাবেলা করছিলেন তখন। যেমন ন্যাপের সেক্রেটারি জেনারেল যদু মিয়ার সাথে তিনি দেখা করেননি এই যুক্তিতে যে তিনি তাকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনেও তিনি বক্তব্য দেননি, দেশিবিদেশি সাংবাদিকদের দ্বারা ভূলভাবে ব্যাখ্যাত হবার ভয়ে, পরে তার পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করতে হয়ছিল সাইফুল ইসলামকে। এরকম অনেক বিষয় উঠে এসেছে বইটিতে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে মওলানার ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেবে।
তবে সবচেয়ে বড় জবাব যেটি তা হচ্ছে মওলানার সামনে বাধা হিসেবে কী এবং কোন পক্ষগুলো ছিল, এবং সেইসাথে সেই বাধাগুলো বর্তমানেও প্রাসঙ্গিক কীনা সেসব বিষয় খতিয়ে দেখতে বইটি বিশেষভাবে সহয়ক হবে। তবে তাকে ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন চলাচলে বাধা প্রয়োগ করেছিল, সেই সন্দেহটির অবসান ঘটিয়েছে বইটি। আজও সেই ধারাবাহিকতা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভোগ করে কী না এবং সেই ইতিহাসের অবসান কি আদৌ হয়েছে? তা আমরা খতিয়ে দেখতে পারি। বইটি পাঠকদের স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের আশা-হতাশার বৃহৎ ময়দানে দাঁড় করিয়ে দেবে বলে আমাদের ধারণা।
স্বাধীনতা ভারত ভাসানী
সাইফুল ইসলাম
প্রকাশনী : প্রথমা প্রকাশন
প্রকাশকাল : ২০২৪
দাম : ৫৫০ টাকা।
বইটি কিনতে
স্বাধীনতা ভারত ভাসানী—সাইফুল ইসলাম – বাহিরানা (bahirana.com)