বাহিরানা

২০২৫ সালের বিশ্ব বই শিল্প: উদ্ভাবন, চ্যালেঞ্জ ও রূপান্তরের এক ভবিষ্যৎদর্শন


দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বই শিল্পও তার ইতিহাসের সবচেয়ে গতিশীল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের বিশ্ব বই শিল্প—প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, ভোক্তাদের আচরণের পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক স্যোশিয়-পলিটিকাল প্রবণতাগুলোর কারণে নতুনভাবে গড়ে উঠছে। চলুন দেখে নেওয়া যাক, বই ও প্রকাশনা শিল্পের ভবিষ্যৎকে সংজ্ঞায়িত করছে যেসব ট্রেন্ড:

১. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

লেখালেখিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহকারী ভূমিকা:

সুডোরাইট (Sudowrite) এবং ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি-অ১-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এখন এআই-সমন্বিত লেখার সুবিধা দিচ্ছে ব্যবহারকারীদের। যা লেখকদের প্লট তৈরি, সংলাপ পরিমার্জন এবং এমনকি খসড়া তৈরিতে বিশেষ সাহায্য করছে।

প্রকাশকদের বিশেষ ক্ষমতা:

প্রকাশকরা এখন এআই (AI) ব্যবহার করে সহজেই পাঠকদের পছন্দ-অপছন্দ বিশ্লেষণ করতে পারছেন। এর সঙ্গে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী কার্যক্রম পরিচালনাও সহজ হয়ে গেছে।

  কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা অনুবাদ ও প্রবন্ধের আধিক্য:

যদিও প্রাথমিক স্তরে রয়েছে তবু এআই-এর দ্বারা অনুবাদ করা প্রচুর আর্টিকেলের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। তার ফলাফর যদিও ভালো না, কেননা লেখালেখি ব্যক্তিনির্ভর। ব্যক্তির আবেগ-অনুভূতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেই তাই প্রাণহীন অনুবাদ ও প্রবন্ধের আধিক্য সামগ্রিকভাবে ক্ষতি করছে।

২.  মাল্টিমিডিয়ার আবির্ভাব

অগমেন্টেড রিয়েলিটি বা উদ্দীপিত বাস্তবতা নির্ভর উপন্যাস:

পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউসের মতো প্রকাশকরা অগমেন্টেড রিয়েলিটি নির্ভর প্রিন্ট বই নিয়ে পরীক্ষা করছেন। চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, এই বইগুলো প্রথাগত বইয়ের চেয়ে একদম ব্যতিক্রম। স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে পাঠকেরা বইয়ের কাহিনি বা চরিত্রদের পরিণতি পরিবর্তন করতে পারেন।

ভিন্নধরণের অডিওবুক:

‘স্পটিফাই’ এবং ‘অডিবল’ “চুজ ইউর অওন এডভেঞ্চার”সহ আরো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নতুন অডিওবুক মাধ্যমের নেতৃত্ব দিচ্ছে। যে বইগুলোতে বিভিন্ন অভিনেতাদের কণ্ঠে গল্প বলা হয় এবং শ্রোতারা ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমে গল্পের প্লটকে প্রভাবিত করতে পারেন।

৩. পরিবেশ সুরক্ষা সবার আগে

সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশনাশিল্পে জলবায়ুর প্রতি দায়বদ্ধতা দেখা যাচ্ছে:

কার্বন-নিরপেক্ষ প্রকাশনা:

বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন একশভাগ পুনরায় ব্যবহারযোগ্য কাগজ ব্যবহার নিশ্চিত করছে। ইকোলিব্রিস (EcoLibris)-এর মতো স্টার্টআপ তাদের প্রতিটি বই বিক্রির সমানুপাতে গাছ লাগিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

ডিজিটাল-ফার্স্ট উদ্যোগ:

বর্জ্য কমানোর জন্য প্রকাশকরা ই-বুক এবং প্রিন্ট-অন-ডিমান্ড বা যখন প্রয়োজন তখন ছাপানোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

বীজাণু দ্বারা পচনযোগ্য(বায়োডিগ্রেডেবল) বই:

পরীক্ষামূলকভাবে প্রকাশকরা শৈবাল-ভিত্তিক কালি এবং বীজ-সমৃদ্ধ আবাদযোগ্য (প্ল্যান্টেবল) বইয়ের কভার নিয়ে পরীক্ষা করছেন।

৪. বিশ্ব সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে বৈচিত্র্য

 #BookTok বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে: টিকটক (TikTok) এবং এর মতো এ্যাপগুলো এখন ইংরেজি ভাষার বাইরের সাহিত্যকেও উৎসাহিত করছে, যার ফলে নাইজেরিয়া, ভারত ও লাতিন আমেরিকার মতো তৃতীয় বিশ্বের লেখকরা আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নাইজেরিয়ান লেখক আয়োবামি আডেবায়ো-এর সর্বশেষ উপন্যাসকে টিকটক ৫০-এর অধিক দেশে তাদের অ্যালগারিদমের প্রথমদিকে প্রচার করছে।

প্রকাশনাকে বিউনিবেশয়ান করা:

ওয়ান ভয়েস কালেকটিভ (#OwnVoices Collective)-এর মতো হ্যাশট্যাগ মুদ্রিত বইগুলো প্রান্তিক লেখকদের ক্ষমতায়ন করছে।

হাইব্রিড প্রকাশনার উত্থান:

ওয়াটপ্যাড (Wattpad) এবং সাবসটেক (Substack)-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো লেখকদের প্রথাগত প্রকাশনাশিল্পকে এড়িয়ে যেতে সাহায্য করছে। অ্যাপের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে বইয়ের অধ্যায় প্রকাশিত হওয়া উপন্যাসগুলো লক্ষাধিক  সাবস্ক্রাইবারভিত্তিক পাঠক আকর্ষণ করছে।

৫. বই নিষিদ্ধকরণের নতুন পদ্ধতি:

 এআই (AI)-চালিত সেন্সরশিপ: বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো তাদের বিবেচনায় “সেন্সিটিভ কনটেন্ট” চিহ্নিত করতে এআই (AI) ব্যবহার করছে।

৬. শ্রম আন্দোলন প্রকাশনা শিল্পে সমতা আনছে

করোনা উত্তর সময়ে ন্যায্য মজুরি ও অন্তর্ভুক্তির দাবি এখন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে:

প্রকাশনা জগতে সংঘবদ্ধতার প্রসার:

ষাট শতাংশের বেশি বড় প্রকাশনী এখন সংঘবদ্ধ কর্মীবাহিনী নিয়ে কাজ করছে। হার্পারকলিন্স (HarperCollins) ইউনিয়ন রিমোট-ওয়ার্ক পলিসি ও প্রফিট-শেয়ারিং বা মূলধন ভাগ মডেলের অগ্রদূত। যদিও বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পে ন্যায্য মজুরির কথাটি এখনও অবাস্তব লাগে শুনতে।

 বেতন বৈষম্য রোধে এআই(AI) অডিট:

বেতন বৈষম্যরোধ করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন, ইক্যুইটিস্ক্যান (EquityScan) ব্যবহার করে বেতনকাঠামোতে জাতি বা লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য চিহ্নিত করছে।

৭. জেন জেড ও আলফা: সাহিত্যের নতুন শক্তিকেন্দ্র

সংক্ষিপ্ত ধারাবাহিক ফিকশন:

র‌্যাডিশ (Radish) ও ট্যাপাস (Tapas) অ্যাপগুলো তরুণদের পড়ার নতুন অভ্যাসের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে নিজেদের সাজাচ্ছে। যেমন, পাঁচ মিনিট পড়া যায় এমনভাবে তাদের গল্পগুলোর অধ্যায় ভাগ করছে তারা। কারণ বৈশ্বিকভাবেই পাঠকদের মনোযোগ কমে গেছে।

প্রথাগত বই পড়ার অভ্যাসের পুনরুত্থান:

প্রথাগত পড়ার অভ্যাসেও ফিরছে পাঠরেরা, লাইব্রেরিতে পাঠকদের ভিড় সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

ডিপফেক ব্যবহার করে চুরি:

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে জনপ্রিয় লেখকদের বইয়ের নকল বই মার্কেটে ভেসে বেড়াচ্ছে, এই নকল বইগুলো এআই ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক চাপ:

মুদ্রাস্ফীতি ও কাগজের ঘাটতির কারণে ছোট ও স্বাধীন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

শেষে বলা যায় ২০২৫ সালের বই শিল্প ক্রমেই গতিশীল তবু অংশগ্রহণমূলক এক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছে।

বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন বিষয়গুলো আপনাকে সবচেয়ে বেশি উত্সাহিত বা উদ্বিগ্ন করে? আপনার মতামত শেয়ার করুন!


মন্তব্য করুন