“মানুষ বেঁচে থাকে মূলত এক স্মৃতি হয়ে উঠতে”, এরকমটাই বলেছিলেন আর্হেন্তিনার কবি এবং এ্যাফোরিস্ট আন্তনিও পোর্কিয়া। বাংলা ব্যান্ড সংগীত জগতের কিংবদন্তী শিল্পী এবং গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু স্বশরীরে আমাদের মাঝে নেই প্রায় পাঁচ বছর হলো। তার শূন্যতাকে পূরণ করতে এখন তার গান আর স্মৃতিই ভরসা। আইয়ুব বাচ্চু যেহেতু নিজের আত্মজীবনী লেখেননি তাই তাকে নিয়ে অন্যদের স্মৃতিকথা তাঁর না লেখা আত্মজীবনীর অভাব পূরণ করতে পারে এবং ভবিষ্যতের কোনো আত্মজীবনীকারের জন্যেও রসদ জোগাতে পারে। সেই কাজটিই খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করেছেন সংগীতশিল্পী ও আইয়ুব বাচ্চুর ঘনিষ্ঠজন জয় শাহরিয়ার, আইয়ুব বাচ্চুর সতীর্থ, বন্ধুবান্ধব এবং অগ্রজদের কাছে জমা তাকে নিয়ে মহার্ঘ স্মৃতিগুলোকে দু্ই মলাটবদ্ধ করেছেন তিনি। আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে জয় শাহরিয়ারের “রুপালি গিটার” স্মৃতিচারণামূলক জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এ বছর।
স্মৃতিকথাগুলোর মাঝে গোপনে জড়িয়ে থাকা একটি বাড়তি পাওয়া হলো এগুলোতে আইয়ুব বাচ্চুর জীবনের নানাদিক উঠে আসার সাথে সাথে তার তাঁর সময়কেও আমাদের কাছে তুলে ধরে। গানের জন্য তাঁর সংগ্রাম পরোক্ষভাবে বাংলা ব্যান্ড গানের সেই সোনালী ইতিহাসের সময়পর্বটিকেও স্পষ্টভাবে নিয়ে আসে আমাদের সামনে।
নকীব খানের স্মৃতিকথার শিরোনাম “বাচ্চুকে মনে পড়ে”, কুমার বিশ্বজিৎ লিখেছেন “বাচ্চু আমার বন্ধু”। বাপ্পী খানের লেখার শিরোনাম “এবি রোমন্থন” সাইদ হাসান টিপু লিখেছেন “আইয়ুব বাচ্চু : রুপালি গিটার ফেলে”। এভাবে একে একে এসেছে আরও অনেকের স্মৃতিকথা যেখানে একজন সংগীতকারকে অন্তরঙ্গভাবে পাই আমরা, বাচ্চুর জীবনের বিভিন্ন দিক ফুটে ওঠেছে লেখাগুলোয়। বস্তুত বইটি ছাড়া তাঁর জীবনের যে গল্পগুলো আমাদের কখনওই জানা হতো না । বইটির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিগদ্য শহীদ মাহমুদ জঙ্গী’র “বাচ্চুর সেই সময়”। আইয়ুব বাচ্চুর বেড়ে উঠার সময় নিয়ে অনেক অজানা কথা উঠে এসেছে এই লেখাটিতে। ষোল সতের বছরের এক তরুণ গায়ক হতে সবকিছু বাজি রাখতে চেয়েছিল— এরকমই এক তরুণের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ করিয়ে দেন শহীদ মাহমুদ। আরেকটি মূল্যায়নধর্মী লেখা জয় শাহরিয়ারের বাংলা ব্যান্ডসংগীতে আইয়ুব বাচ্চুর অবদান নিয়ে “আইয়ুব বাচ্চু: বাংলা রকের ছায়াবৃক্ষ”। এই লেখাটিও বইটিতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। এ ছাড়াও বইটিতে যুক্ত হয়েছে আইয়ুব বাচ্চুর একটি অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার এবং ডিস্কোগ্রাফি, যেখানে রয়েছে তাঁর সব গানের অ্যালবামসহ ছয়শ গানের তথ্য। সাক্ষাৎকারটি বইটির এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন সন্দেহ নেই তবে ডিস্কোগ্রাফিতে তাঁর সব গানের তথ্য গন্থবদ্ধ করাও বইটিকে বিশেষভাবে সম্মৃদ্ধ করেছে। তবে একটি অপূর্ণতার কথা বলা যায়, আইয়ুব বাচ্চুর সাথে দীর্ঘদিনের পথ চলা বাংলা ব্যান্ডের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র জেমসের, বইটিতে বাচ্চুকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিগদ্য থাকলে বইটি আরও সম্মৃদ্ধ হতো।
বইটি সুসম্পাদিত, একে সম্মৃদ্ধ করতে জয় শাহরিয়ার তার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেননি। ফলে একটি সম্মৃদ্ধ বই পেয়েছি আমরা। আর স্মৃতিকথাগুলোর মাঝে গোপনে জড়িয়ে থাকা একটি বাড়তি পাওয়া হলো এগুলোতে আইয়ুব বাচ্চুর জীবনের নানাদিক উঠে আসার সাথে সাথে তার তাঁর সময়কেও আমাদের কাছে তুলে ধরে। গানের জন্য তাঁর সংগ্রাম পরোক্ষভাবে বাংলা ব্যান্ড গানের সেই সোনালী ইতিহাসের সময়পর্বটিকেও স্পষ্টভাবে নিয়ে আসে আমাদের সামনে। “এখন অনেক রাত”-এর “জীবনের অনেক আয়োজন ফেলে” চলে যাওয়া অভিমানী শিল্পীকে গভীরভাবে জানতে সাহায্য করবে বইটি।
রুপালি গিটার
সংকলন ও সম্পাদনা : জয় শাহরিয়ার
প্রকাশক : আজব প্রকাশ
প্রকাশকাল : ২০২৩
প্রিষ্ঠাসংখ্যা : ১৮৪
দাম : ৫০০ টাকা।