বাহিরানা

বই রিভিউ গহিনের স্রোতধারা: এশিয়ার নারীসাধকদের জীবন ও কবিতা—সাহিত্য ও আধ্যাত্মিকতায় মুক্তি


দিপু চন্দ্র দেব

পৃথিবীতে মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতা লুপ্ত হয়েছিল সম্পদের মালিকানার পক্ষ বদলের মাধ্যমে। এরপর হাজার-হাজার বছর চলে গেছে, সম্পদ আরো বেশি একত্রীভূত হয়েছে গুটিকয়েক মানুষের হাতে। ধীরে ধীরে ক্ষমতাহীন নারী ও পুরুষ, সবাইকেই তাদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়েছে। বস্তুগত সমাজ বর্তমানে এরকমই। তবে, মুক্তি কোথায়? মুক্তি সমাজ বদলে। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক রূপান্তরই মুক্তি দিতে পারে। এখানেই কবিতা, আর আধ্যাত্মিকতার কথা এসে যায়। কারণ এই দুটি বিষয় মানব সভ্যতার সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে আছে সূচনা থেকেই। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এই দুই একক থেকেই সবচেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক আধিপত্য নির্মাণের উপাদান সংগ্রহ করে আসছে। আধ্যাত্মিক সাধনায় যে শুধু পুরুষদেরই আধিপত্য এরকম নয়, নারীরাও এই সাধনায় যুক্ত ছিলেন প্রাচীনকাল থেকে। তারা তাদের সাধনার বহিঃপ্রকাশে একইসাথে কবিতাও লিখেছেন। আলোচ্য বই, হাসিবা আলী বর্ণার অনুবাদে “গহিনের স্রোতধারা: এশিয়ার নারীসাধকদের জীবন ও কবিতা”-এই নারী সাধকদের নিয়েই, যাদের জীবন, কবিতা ও সাধনার মধ্য দিয়ে আজও বহমান। সময়কাল হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন (খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দ-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)। বইটি সময়ের বিবেচনায় প্রাচীন ও আধুনিককালের পরিধিতে আছে।

বইটিতে আমরা পাই, এনহেদুয়ান্নার সময়ের বহু শতাব্দী পরের ইরাকেরই “বসরা” নগরীর “রাবি ‘আ আল আদাবিয়্যা” বা নগরীর নামে পরিচিত “রাবেয়া আল বসরী”কে, ‍যিনি মুক্তির সাধনায় ‘আল্লাহ’র প্রতি ভালোবাসাকেই বেছে নিয়েছিলেন।

ভারতীয় দর্শনের একটি মূল লক্ষ্য হলো দুঃখমুক্তি, জগতের ভার, চেতনার ভার থেকে মুক্তি। বুদ্ধ দর্শন এর মধ্যে অন্যতম। বইয়ে উল্লেখিত দুইটি বিপরীত সামাজিক অবস্থান থেকে উঠে আসা দুই নারী সাধকের কথা বলা যেতে পারে, গৌতম বুদ্ধের সরাসরি শিষ্য ছিলেন থেরীগাথার “সুমানগালমাতা” সংসারের বঞ্চনায় বিক্ষুদ্ধ হয়ে তিনি বুদ্ধের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আরেকজন, খ্রীস্ট জন্মেরও পূর্বে আজ থেকে চার হাজার তিনশ বছর আগের বর্তমান ইরাকাকের কবি “এনহেদুয়ান্না”।

এই কবি সুমানগালমাতা’র একদম বিপরীত সামাজিক অবস্থানের, ছিলেন রাজকন্যা। আক্কাদিয়ান সভ্যতার সম্রাট সারগন ও রানি তাশলুলতুমের মেয়ে। এই নারী ছিলেন মেসোপটেমিয়ার প্রধান পুরোহিত। বইটিতে এরকম অসংখ্য নারী সাধকদের নিয়ে এসেছেন হাসিবা আলী বর্ণা। যাদের বৈপরীত্য— সাধনায়, জীবনসংগ্রামে ও সাহিত্যে—বিস্ময়কর। তারা এশিয়ার, আর অঞ্চলটি আধ্যাত্মিকতার ঊর্বরভূমি। এখানে দুই নারী সাধকের কবিতা দেখা যেতে পারে,

অবশেষে মুক্তি
আহা, আমি মুক্ত নারী।
রান্নাঘরের ঘেরাটোপ থেকে এই মুক্তি
কী যে চমৎকার!
….
শান্ত এখন, নির্মল এখন আমি
নিজ বৃক্ষের ছায়ার নিচে বসে
স্থির-সমাহিত, সুখী।

(থেরীগাথা, সুমানগালমাতা)

সবচেয়ে প্রাচীন ও করাল মন্দির—
পর্বতের গহিনে
মায়ের জঠরের মতো অন্ধকার
অন্ধকার মন্দির সেই
মায়ের বিক্ষত বুকের মতো
লাল, রক্তাক্ত আর ভয়াবহ।
যদিও এখানেই নিরাপত্তার সেই ভূমি
যেখানে চুলের দূরত্বসমান কাছে তুমি

(এনহেদুয়ান্না)

তাদের কবিতায় বিষয়বস্তু ও গঠনও ভিন্ন, এনহেদুয়ান্নার কবিতাটি প্রস্তরখণ্ডে খোদিত ছিল।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে স্থান পাওয়া “গার্গী বাচক্নবী”, ব্রহ্মার অস্তিত্ব নিয়ে ‍যিনি যাগ্যবল্ক্যের সাথে তর্ক করেছিলেন। তাকেও পাওয়া যায় বইটিতে।

বইটিতে আমরা পাই, এনহেদুয়ান্নার সময়ের বহু শতাব্দী পরের ইরাকেরই “বসরা” নগরীর “রাবি ‘আ আল আদাবিয়্যা” বা নগরীর নামে পরিচিত “রাবেয়া আল বসরী”কে, ‍যিনি মুক্তির সাধনায় ‘আল্লাহ’র প্রতি ভালোবাসাকেই বেছে নিয়েছিলেন। তার সুফি কবিতা,

“যদি দোজখের ভয়ে নেই নাম তোমার
জাহান্নামের আগুন তবে আমাকে পোড়াক।
যদি বেহেশতের লোভে গাই নাম তোমার
জান্নাতের দরজা তবে বন্ধ হয়ে যাক।
যদি ডাকি তোমায় তোমারই প্রেমে
তবে নিও না মুখ সরিয়ে আড়ালে!”

তিনি পরিচিত হয়েছিলেন তার নগরের নামে, আর “সুমানগালমাতা” তার ছেলের নামে, ‍যিনি নিজের নাম ব্যবহার করতে পারেননি। এখানে পার্থক্যটি স্পস্ট, সময়ের সাথে সাথে অগ্রগতির ছাপ লক্ষণীয়।

বইটি আধ্যাত্মিক সাধনায় মুক্তি পথে ও আধিপত্যবাদের বিনাশে নারীসাধক কবিদের অবদান তুলে ধরে বর্তমান সময়কে বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বইটি আধ্যাত্মিক সাধনায় মুক্তি পথে ও আধিপত্যবাদের বিনাশে নারীসাধক কবিদের অবদান তুলে ধরে বর্তমান সময়কে বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সাধক নারীদের জীবন ও কবিতায় আগ্রহীদের পাঠ আনন্দের সাথে সাথে নতুন করে সমাজ-সভ্যতাকে বিবেচনা করার রসদও দেবে।

গহিনের স্রোতধারা: এশিয়ার নারীসাধকদের জীবন ও কবিতা
লেখক: হাসিবা আলী বর্ণা
বিষয়: জীবনীগ্রন্থ, কবিতা
প্রকাশকাল: ২০২৪
প্রকাশক: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউ পি এল)
দাম: ৪৫০টাকা ২০% ছাড়ে বাহিরানাতে ৩৬০ টাকা।

বইটি কিনতে হলে:

গহিনের স্রোতধারা : এশিয়ার নারীসাধকদের জীবন ও কবিতা (Gohiner Shrutodhara: Asiar Narishadhokder Jibon O Kobita) – বাহিরানা

(Visited 24 times, 1 visits today)

Leave a Comment