“জীবন এত ছোট ক্যানে” (কবি)। বাংলা উপন্যাসে দার্শনিকতায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের এই বাক্যটির একটি ভূমিকা আছে। বাক্যটি এত বেশি ছড়িয়েছে যে সাধারণ মানুষ থেকে ভাবুক প্রায় সবার কাছেই পরিচিত। এটা যে একটি উপন্যাস থেকে এসেছে অনেকেই সেটা জানেন না। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (২৩ জুলাই ১৮৯৮ – ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১) কবি (প্রথম প্রকাশ, ১৯৪২ সাল) উপন্যাসাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে পাটনা থেকে প্রকাশিত “প্রভাতী” পত্রিকায় ১৯৪২ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। তারাশঙ্কর ছিলেন জমিদার পরিবার থেকে আসা সাহিত্যিক। বিরভূম জেলায় ছিল তার পৈত্রিকবাস। ৬৫ টি উপন্যাস ও অসংখ্য গল্পগ্রন্থ ও ভ্রমণকাহিনীর লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনকে দেখেছিল বিচিত্ররূপরে। এসব দেখাই তার উপন্যাসে ঘুরেফিরে এসেছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১২ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ – ১ নভেম্বর ১৯৫০) দুইজনই ছিলেন সমসাময়িক, বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল একই সময়ে বর্তমান ছিলেন তা আশ্চর্য করে বৈকি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসপথের পাঁচালি আরণ্যক, দৃষ্টিপ্রদীপ যেমন বাংলা সাহিত্যের মহৎ সংযোজন তেমনি মহৎ সংযোজন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাস।
উপন্যাসটির বিশেষত্ব হচ্ছে এর দার্শনিকতা, শক্তিশালী চরিত্র, ও সহজ-স্বাভাবিকতার গভীরতা।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের কেন্দ্রয়ী চরিত্র নিম্নশ্রেণীর কবিয়াল “নিতাইচরণ”। গ্রামের এক কবিগানের আসরে কবিয়ালের অনুপস্থিতিতে সে কবিয়াল হয়ে ওঠে। নিতাই ডাকাত বংশের। ডাকাত বংশের কেউ কবিয়াল হয়ে গেলে, সেটাকে বিরাট এক পালাবদল বলা যায়। কিন্তু সাহিত্য আর ডাকাতি এক হিসেবে দুই-ই সমাজের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ। তারাশঙ্কর নিতাই আর ঝুমুরদলের মাধ্যমে জীবনের অন্য এক অভিজ্ঞতা তুলে এনেছেন উপন্যাসটিতে।
নিতাইচরণের জীবন উত্থান-পতনের, সফলতার, বিরহের, প্রেমের, পাওয়া না পাওয়ার, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সফল হওয়া ও সেই সফলতা থেকে ফিরে আসার। তার জীবনের দুইটি অধ্যায়, প্রথম অধ্যায়ে আমরা দেখি বাড়ি ছেড়ে স্টেশনে যাওয়া, পড়াশোনা করতে চাওয়া, বংশগত ডাকাতির পেশায় না ঢুকতে চাওয়া। আর এই অস্থির সময়ে বন্ধু রাজার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া ঠাকুরঝির সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া। উপন্যাসে যে বাক্যগুলো প্রবাদে পরিণনত হয়েছে তার সবই নিতাইচরণ ঠাকুরঝিকে উদ্দেশ্য করে বানিয়েছে। যেমন, “জীবন এত ছোট ক্যানে” সে বলেছিল যখন সে ঝুমুরদল থেকে ফিরে জানতে পারে তার অবর্তমানে ঠাকুরঝি পাগল হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ঠাকুরঝি কালো ছিল তাই তার প্রতি মমত্ববোধে সে গানের পঙক্তি বেঁধেছিল, “কালো যদি মন্দ তবে চুল পাকিলে কান্দ কেনে?” । আর দ্বিতীয় অধ্যায়, বাড়ি ছেড়ে মা-বাবা-বন্ধু-ঠাকুরঝিকে পেছনে ফেলে পালিয়ে ঝুমুরদলে যোগ দেওয়া। কারণ ঠাকুরঝি ছিল বিবাহিতা, আর তাদের সম্পর্ক গ্রামে লোকমুখে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। ঠাকুরঝিকে রক্ষা করতেই সে গ্রাম ছেড়ে ঝুমুরদলে যোগ দেয়। সেখানে বসন্ত নামে এক নারীর সাথে তার প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বসন্ত মারা গেলে সে আবার বাড়ি ফেরে। কিন্তু ফিরে সে জানতে পারে ঠাকুরঝি নেই। এই না থাকার হাহাকার তাকে জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসটির বিশেষত্ব হচ্ছে এর দার্শনিকতা, শক্তিশালী চরিত্র, ও সহজ-স্বাভাবিকতায় ছড়ানো গভীরতা। ফলে সহজেই আখ্যানটি মানুষের জীবনের অন্তর্গত আশা-হতাশার সাথে নিজেকে একাত্ম করে ফেলে। আমরা সবাই-ই কম-বেশি দার্শনিক, তবে জীবনের ভেতর ডুব দিয়ে তার অর্থ-অনর্থকে তুলে আনার দীক্ষা সবার থাকে না। শিল্পীরা সেটা সহজেই পারেন, তার সমাজের অসাম্যকে শনাক্ত করতে পারেন, তাদের ভেতর বিদ্রোহ জেগে ওঠে তখন। আর সব অর্জনের শেষে যেমন বসে থাকে একজন বনলতা সেন, তেমনি কবিয়াল নিতাই আমাদের শোনায় “জীবন এত ছোট ক্যানে”। কিন্তু এই ছোট জীবটাকেই সার্থকভাবে যাপন করাই আমাদের কাজ। বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছে পাঠক সমাবেশ।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় তার গল্প, উপন্যাসের মাধ্যমে তার পরবর্তী সাহিত্যিকদের কাছেও পৌঁছাতে পেরেছেন সফলভাবে। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হক বাহিরানা Talk-এ বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করেছেন।
কবি
লেখক : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
বিষয় : শাশ্বত উপন্যাস
প্রকাশকাল : ২০২৪
প্রকাশক : পাঠক সমাবেশ
দাম : ২৯৫ টাকা।
