দিপু চন্দ্র দেব
ভাস্কর্যশিল্পী নভেরা আহমেদকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ বেশি হয়নি। হাসনাত আবদুল হাইয়ের “নভেরা” নামে উপন্যাস আছে একটি। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য একটি গবেষণা বই আছে কবি সাখাওয়াত টিপু’র “নভেরার রূপ” শিরোনামে। সেখানে প্রকৃত নভেরাকে প্রকাশিত করার চেষ্টা আছে এবং শহীদ মিনারের নকশায় এই শিল্পীর অবদান কতখানি তা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা আছে। মূল নকশা যে হামিদুর রহমান না বরং নভেরা আহমেদই করেছেন তা নিয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন সাখাওয়াত টিপু। যারা এই শিল্পীর কাজ ও জীবনের গভীরতা ও অর্থ জানতে চান তাদের জন্য বইটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কিংবদন্তি এই শিল্পী তো প্রায় আত্মগোপনেই ছিলেন জীবনের বেশিরভাগ সময়, কেমন ছিল তার প্যারিস পর্ব? এ নিয়েই আনা ইসলামের “নভেরা বিভূঁইয়ে স্বভূমে” নভেরার আত্মজীবনী বা শিল্পীকে নিয়ে লেখিকার স্মৃতিগ্রন্থ।
এই বাক্যগুলো পড়ে যুগপৎ দুইটি বেদনার মুখোমুখি হই আমরা, প্রথমত, নভেরার দেশ ত্যাগের বা নির্বাসনের একটি বড় কারণ এই নকশা, যার স্বীকৃতি তাকে দেওয়া হয়নি, আর বেদনা আরো বাড়ে যখন তার স্বামীর মুখে শুনি নকশার কথাটি তিনি বহুবার তাকে বলেছেন, মানে সারাজীবনই ক্ষতটি তার ভেতরে তপ্ত লালরঙ ধারণ করে ছিল। দ্বীতিয়টি হলো, ভালোবাসার জনকে হারিয়ে তার স্বামী গ্রেগোয়ারের সেইজনের (নভেরা) কাজ (নকশা)কে আকড়ে ধরতে চাওয়ার বাসনা, মনের ভেতর তাকে জীবন্ত করে রাখার চেষ্টা।
বইটি আমাদের সামনে অন্য একজন মানুষকে নিয়ে আসে, যিনি বহুকাল স্বদেশ দেখেননি, স্বেচ্ছা নির্বাসনে তিনি। আনা ইসলামের সুখকর গদ্যে যেন স্মৃতিকাতর প্রকৃতির মধ্য দিয়ে তিনি প্রকাশিত হন, “সন্ধে, ছয়টা, প্রকৃতি ডুবে আছে উজ্জ্বল তপ্ত রোদে। দোতলা ভবনের পেছনে বাগান। গাছপালা, ফুলের শোভা। একতলা, দোতলা ঘরজুড়ে চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য সাজানো।”
উক্ত বাক্যগুলোতে থাকা ভাস্কর্যগুলো, প্যারিসে ২০১৮ সালে উদ্বোধন হওয়া “নভেরা মিউজিয়াম”-এর। এর প্রায় তিন বছর আগে নভেরা আহমেদ দেহ ত্যাগ করেছেন। এই প্যারিসেই নব্বইয়ের দশকে এই শিল্পীকে খোঁজার সময় একটি দুঃখজনক ঘটনার বর্ণনা পাই আমারা বইটিতে, লেখিকাকে প্যারিস দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, “কোথাকার কোন নভেরা, আমাদের এসব মনে থাকে?” এরকম উত্তর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতির দেউলিয়াত্বের দিকেই দিক নির্দেশ করে।
লেখিকা নিজে প্যারিসে থাকেন এবং নভেরাকে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন, তার বাসায় ওনার যাতায়াত ছিল। এই বিষয়গুলো বইটির আবেদন ও গুরুত্ব বাড়িয়েছে। বইটি তিনি শিল্পীকে যেমন দেখেছেন ও তার স্বামী-পরিবারের সাথে যেমন মিশেছেন তারই বর্ণনা। পশ্চিমারা শিল্পের গুরুত্ব কেমন বুঝে তার একটি উদারহরণ দেওয়া যাক বই থেকে, “প্যারিসের একটি রেস্তোরাঁর ছোট টেবিলে মুখোমুখি বসে নভেরার স্বামী গ্রেগোয়ার আর আমি। ক্লান্ত চোখ-মুখ। বললেন, শহীদ মিনারের নকশার কপিটা আপনার কাছে আছে। নভেরার নামও লেখা থাকবে জানি। নভেরার কাছে শুনেছি বহুবার।”
এই বাক্যগুলো পড়ে যুগপৎ দুইটি বেদনার মুখোমুখি হই আমরা, প্রথমত, নভেরার দেশ ত্যাগের বা নির্বাসনের একটি বড় কারণ এই নকশা, যার স্বীকৃতি তাকে দেওয়া হয়নি, আর বেদনা আরো বাড়ে যখন তার স্বামীর মুখে শুনি নকশার কথাটি তিনি বহুবার তাকে বলেছেন, মানে সারাজীবনই ক্ষতটি তার ভেতরে তপ্ত লালরঙ ধারণ করে ছিল। দ্বীতিয়টি হলো, ভালোবাসার জনকে হারিয়ে তার স্বামী গ্রেগোয়ারের সেইজনের (নভেরা) কাজ (নকশা)কে আকড়ে ধরতে চাওয়ার বাসনা, মনের ভেতর তাকে জীবন্ত করে রাখার চেষ্টা।
বইটি এসব কারণেও গুরুত্বপূর্ণ যে, আনা ইসলামের লেখায় নির্বাসিত নভেরা জীবন্ত প্রতিকৃতির মুখোমুখি হই আমরা। অতৃপ্ত, বেদনাগ্রস্থ এক সত্তার সামনে দাঁড়াতে হয় আমাদের, কিন্তু প্রবল আত্মসম্মানবোধসমন্ন, একজন প্রকৃত শিল্পীও আছে সেখানে, একইসাথে। বইটিতে শিল্পীর কিছু দুর্লভ ছবিও যুক্ত করেছেন আনা ইসলাম। তাই নভেরা পাঠে বইটি বিশেষ ও একইসাথে স্বভূমের পাশাপাশি “বিভূঁইয়ে”-একেও সঙ্গে নিয়ে শিল্পীর প্রতিকৃতি পূর্ণাঙ্গভাবে গড়তেও প্রয়োজনীয়। কারণ তার প্যারিসবাস সম্পর্কে আমরা তেমন কিছু জানি না, বইটি সেই জানানোর কাজটি সুন্দরভাবে করেছে।
নভেরা বিভূঁইয়ে স্বভূমে
লেখক : আনা ইসলাম
বিষয় : জীবনীগ্রন্থ
প্রকাশকাল : ২০২০
প্রকাশক : জার্নিম্যান বুক্স, অন্যপ্রকাশ
দাম : ১৫০০ টাকা।