বাহিরানা

মতিউর রহমানের গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি রিভিউ—বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার বই


মতিউর রহমানের গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি রিভিউ:

কোনো বিপ্লবীর জীবনী গবেষণায় সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ তথ্যের উপর জোর দিতে হয়, কোনো একটি তথ্যের খোঁজ পেতে হয়তো বহুদিন বা বছর লেগে যেতে পারে। যাচাই বাছাই তো আছেই, কারণ তথ্যটি ভুল প্রমাণিতও হতে পারে। ফলে, যিনি গবেষণা করছেন তার মধ্যে অসীম ধৈর্য ও বৈজ্ঞানিকের অনুসন্ধানী মন থাকতে হয়। আর সেই বিপ্লবীর সংযোগ যখন সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে—লেলিন ও পরে স্তালিনের(যার কারণে তার জীবনবসান হয়) সঙ্গে—এবং একইসাথে তিনি যদি বাংলাদেশের হন। তাহলে তার জীবনী রচনা করা বিপ্লবের চেয়ে কম নয়, কারণ ব্রিটিশ ভারতের বামপন্থী নেতৃত্বের যে গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে সেখান থেকে এবং রাশিয়ার গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে, এর সাথে বেঁচে থাকা সাক্ষীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য তো আছেই। এই কাজকে অসম্ভব বলা যায়। কিন্তু এটা সম্ভব হয়েছে মতিউর রহমানের “গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি” বইয়ে, বইটি বাংলাদেশের একজন বিপ্লবীর কাহিনি, যা অন্তরালে ছিল বহু বছর।

গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর উপর মতিউর রহমানের প্রায় ৪২ বছরের গবেষণার উপর গড়ে উঠেছে বইটি। তিনি নিজে সাংবাদিক হওয়ায় তথ্যের বিষয়ে কোনোরূপ ছাড় দেননি।

লুহানীর জন্ম ১৮৯২ সালে পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জে। তিনি ১৯১৪ সালে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে লন্ডনে যান, সেখানেই ১৯১৭ সালে বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি তার আগ্রহ গড়ে ওঠে। শ্রমিক শ্রেণীর হয়ে লন্ডনে কাজ করার অবসরে তার জীবন যাপিত হতো সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতায়। এরপর দীর্ঘ এক যাত্রার সূচনা হয় ১৯২১ সালে, প্রথমে প্যারিস এরপর বার্লিন হয়ে প্রথমবারের মতো মস্কো পৌঁছান। কিন্তু লেলিনের সাথে তার বহু প্রত্যাশিত সাক্ষাৎ হয়নি।

এই যাত্রা চলতে থাকে, বার্লিনে ফিরে কাজ শুরু করেন ভারতের মুক্তির লক্ষ্যে, পালাক্রমে জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড—এই দেশগুলোতে তার কাজের ক্ষেত্র বিস্তৃত ছিল। লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও। পরে আবার ১৯২৫ সালে মস্কো’তে গমন, এরপর সেখানে কমিনর্টানসহ অনেক সংস্থায় কাজ করেছেন। সংস্থাগুলো রাশিয়ার জন্য বিশেষ। আরেকটি বিশেষ দিক হলো, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের জন্যেও লিখেছেন তিনি। ১৯২৮ সালে তিনি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। বিয়েও করেন রাশিয়ার এক নারীকে। ষষ্ঠ কংগ্রেসে তিনি ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বক্তৃতা করেছেন।

১৯৩৩ সালে লোহানী রাশিয়ার নাগরিকত্ব পান। কিন্তু তখন স্তালিনের স্বৈরশাসন চলছিল, চারিদিকে ব্যাপক ধরপাকড়। সন্দেহ সবখানে, সবার দিকে। স্বদেশি, বিদেশি কমিউনিস্ট কাউকেই রেহাই দেওয়া হচ্ছিল না। আম্বিয়া খান লুহানী—এই সন্দেহেরই শিকার হয়ে পরিণামে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত হন। ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার এবং ১৭ সেপ্টেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডে সামরিক আদালতের নির্দেশে মৃত্যু কার্যকর করা হয় এই মহান বাংলাদেশি বিপ্লবীর। কিন্তু বহু বছর তার খোঁজ কেউ জানেনি।

রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের পর সব আর্কাইভ ও লাইব্রেরীগুলো উন্মুক্ত হতে শুরু করে, তখন গবেষক ও সাংবাদিক লিওনিদ মিত্রোখিন রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির ফাইলে লুহানীর নাম আবিষ্কার করেন, তার গ্রেপ্তার ও মৃত্যুদণ্ডের কথাও আছে সেখানে। আরো দুইজন বিপ্লবী একই ভাগ্য বরণ করেছিলেন, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও অবনীনাথ মুখার্জি, তাদের কথাও লেখেন তিনি।

গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর উপর মতিউর রহমানের প্রায় ৪২ বছরের গবেষণার উপর গড়ে উঠেছে বইটি। তিনি নিজে সাংবাদিক হওয়ায় তথ্যের বিষয়ে কোনোরূপ ছাড় দেননি। বাংলাদেশের একজন বিপ্লবী যিনি বৈশ্বিক মঞ্চে আরোহন করেছিলেন এবং বরণ করেছিলেন দুঃখজনক পরিণতি, তাকে জানাতে ও প্রতিষ্ঠা করতে এই বইটি বিরাট ভূমিকা পালন করবে। বিশ্বমঞ্চেও বাংলাদেশের নিশানা এই বিপ্লবী, তার উত্তরাধিকার সরবে ঘোষণা করবে এই বই।

গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি
লেখক: মতিউর রহমান
বিষয়: জীবনীগ্রন্থ
প্রকাশকাল: ২০২৪
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
দাম: ৬০০ টাকা।

বইটি কিনতে চাইলে:

গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি(হার্ডকভার) – Golam Ambia Khan Lohani Ek Ojana Biplobir Kahini – বাহিরানা

(Visited 4 times, 4 visits today)

Leave a Comment