বাহিরানা

খুলিও কোর্তাসারের অনুসরণকারী: মূলানুগ অনুবাদ কিন্তু মূলের সুরটিও আছে


আর্হেন্তিনার কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে হোর্হে লুইস বোর্হেস, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ছাড়াও যে কয়জন সাহিত্যিক অগ্রগণ্য তাদের অন্যতম হুলিও কোর্তাসার। শুধু সাহিত্যিক সম্পর্ক ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে মার্কেস এবং হুলিও কোর্তাসার দুইজন ঘনিষ্ট বন্ধুও ছিলেন। আমাদের আলোচ্য বই জয়া চৌধুরীর অনুবাদে খুলিও কোর্তাসারের অনুসরণকারী গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। জয়া চৌধুরী Julio Cortázar-কে অনুবাদ করেছেন খুলিও কোর্তাসার কিন্তু স্প্যানিশ J এর উচ্চারণ বাংলায় হয় হ, তাই Julio হয় হুলিও, খুলিও নয়। আমরা এই আলোচনায় জয়া চৌধুরীর দেওয়ার লেখকের নামের বাইরে “হুলিও” শব্দটি ব্যবহার করব, সেটি সঠিক বিধায়। কারণ জয়া চৌধুরীর দেওয়ার স্প্যানিশ থেকে বাংলার  অনুসরণকারী হলে আমাদেরকে হুর্হে লুইস বোর্হেসকে খোর্হে লুইস বোর্খেস বলতে হবে।

কোর্তাসার গল্পটির প্রথম বাক্যের আগে ডিলান টমাসের একটি কবিতার লাইন দিয়েছেন, “অথবা আমাকেই মুখোশ বানিয়ে দিও” (অনু:জয়া চৌধুরী) এর উপর আরেকটি বাক্য, “মৃত্যু অবধি অনুগত থাকব জানি” এ্যাপোক্যালিপস ২/১০(অনু: ঐ)। এই দুইটি উদ্ধৃতি এই গল্প বা নভেলাটির জটিলতা খুব দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলে। যেন পাঠকদের গোলকধাঁধার আমন্ত্রণ জানায়।

জয়া চৌধুরী গল্পটির অসাধারণ বাংলা অনুবাদ করেছেন, তিনি ইংরেজি নয় মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করেছেন। মূলানুগের পাশাপাশি তিনি মূলের সুরটিও বাংলায় সঞ্চার করতে চেয়েছেন।

জ্যাজ শিল্পী জনি কার্টার এবং তার সমালোচক ও জীবনীকার ব্রুনুর সঙ্গীতকে দেখার বৈসাদৃশ্যের উপর ভিত্তির করে ঔপন্যাসিকাটি এগিয়ে চলে। জনি যেখানে সঙ্গীতকে যেভাবে আত্মগতভাবে তার বিপরীতে ব্রুনূ টেকনিকাল বা কাঠখোট্টা পদ্ধতিতে দেখে। যেমন জনি, সঙ্গীত আদতে কী তার শব্দে বলতে পারে না, তার মতে সঙ্গীত বোঝার জিনিস নয়, এটা শুধু আমাদের সাহায্য করে। কোর্তাসার জনি কার্টারের মাধ্যমে একটি প্রশ্ন তুলেছেন, যে সমালোচক সৃষ্টিশীলের সমান আনন্দ পায় কী না। এটা সব শিল্পের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। জয়া চৌধুরী বইয়ের ভূমিকাতে আমাদের জানাচ্ছেন, মার্কিন জ্যাজ সঙ্গীততজ্ঞ চার্লি পার্কারের জীবনী অবলম্বনেই কোর্তাসার জনি কার্টার চরিত্রটি রূপদান করেছেন। কোর্তাসারও “চার্লি পার্কারের স্মৃতিতে” উল্লেখ করেছেন শুরুতেই। অনেকের ধারণা উন্যাসিকাটি এক নিরন্তর ভ্রমণের গল্প। প্রকৃত অর্থেই এর ভেতর এক আত্মিক যাত্রা রয়েছে।

জয়া চৌধুরী গল্পটির অসাধারণ বাংলা অনুবাদ করেছেন, তিনি ইংরেজি নয় মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করেছেন। মূলানুগের পাশাপাশি তিনি মূলের সুরটিও বাংলায় সঞ্চার করতে চেয়েছেন। কয়েকটি বাক্যে তার ঝরঝরে, প্রাঞ্জল অনুবাদের সাক্ষ্য দেখা যেতে পারে,

—ব্রুনো হলো অনুগত সঙ্গী, ঠিক যেমন নিশ্বাসের সঙ্গী দুর্গন্ধ—হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে বসে বসে সম্ভাষণ করার ভঙ্গিতে কথাটা বলছিল জনি। দেদে আমায় একটা চেয়ার এগিয়ে দিলে পকেট থেকে এক প্যাকেট সিগারেট বের করলাম।
….
জনি খুব মন দিয়ে আনমনা হয়ে আমার কথা শুনছিল। ঠিক বিড়াল যেমন করে কোনো দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে অথচ তার মাথা অন্য বিষয়ে ঘোরে।”

এখানে লক্ষণীয়, জয়া চৌধুরী ইচ্ছে করলেই ভাষায় কোমলতা আনতে “বিড়াল” শব্দের পরিবর্তে “বেড়াল” বসাতে পারতেন। কিন্তু কোর্তাসারের গল্পটি কঠোর-কর্কশ ভাষায় লেখা, এ না হলে গল্পটি তার বাস্তব ভিত্তি পেত না, জয় চৌধুরী মূলের সেই কর্কশ ভাবটি বজায় রাখতে “বিড়াল” শব্দটির ব্যবহার করেছেন দারুণ দক্ষতায়। উপন্যাসিকাটির সঙ্গে প্যারিস রিভিউকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারেরও অনুবাদ যুক্ত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন এমদাদ রহমান।

বিংশ শতাব্দীতে—উপন্যাসিকা, বড় গল্প বা গল্প যে ঘরানাতেই ফেলা হোক না কেন—হুলিও কোর্তাসারের অনুসরণকারী এক অবিস্মরণীয় সংযোজন। নেশাসক্ত এক জ্যাজ সঙ্গীতশিল্পী আমাদের সামনে সময় এবং প্রকৃত সময়, সুখ এবং প্রকৃত সুখের জগৎ উন্মোচন করে, যা প্রায়শই ভাষায় প্রকাশযোগ্য হয় না, এই কারণেই সঙ্গীত বোঝার জন্য নয় বলে সে বলে। কোনো শিল্পই কী বোঝার জন্য? জীবনকে কী বোঝা যায়? তাকে তো অনুভব করতে হয়। জয়া চৌধুরীর অনুবাদে খুলিও কোর্তাসারের অনুসরণকারী বাংলা ভাষার পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয় হোক।

অনুসরণকারী
লেখক: খুলিও কোর্তাসার
অনুবাদ: জয়া চৌধুরী
বিষয়: উপন্যাসিকা
প্রকাশকাল: ২০২৩
প্রকাশক: কবি প্রকাশনী
মূল্য: ২০০ টাকা।

অনুসরণকারী উপন্যাসিকাটি কিনতে চাইলে


মন্তব্য করুন