বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি শুরু ও গভীর থেকে বোঝার জন্য যে কয়টি বই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে, তার মধ্যে নৃবিজ্ঞানী ভেলাম ভান সেন্দেলের বাংলাদেশ জনপদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বইটি অন্যতম। বইটির ইংরেজি নাম অ্যা হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৯ সালে। এই ডাচ গবেষক এশিয়ার নৃতত্ত্ব এবং ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন, তিনি নেদারল্যান্ডের ইরাসমুস ইউনিভার্সিটি অব রটরডাম ও আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাক্রমে, তুলনামূলক ইতিহাস ও আধুনিক এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে অধ্যাপক ছিলেন।
শুধু মৌলিক বইই নয়, এ ছাড়াও ভেলাম ভান সেন্দেল দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকানন (১৭৯৮) বইটিও সম্পাদনা করেছেন। বাংলার প্রাচীন বা ঔপনিবেশিক কালপর্বের ইতিহাসের পাশাপাশি সেই বইয়ের ভূমিকায় তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চার কিছু সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছেন যা আমাদের আলোচ্য বইটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যেমন, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদদের ইতিহাসচর্চার দিকে তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। তার মতেরই জলজ্যান্ত নিদর্শন আমরা পাই আরেকটি বই এফ্, সি, ডালি, আই, ই-এর বাঙ্গালাদেশে যে সকল দুর্ব্বৃত্ত জাতি নামে চাঞ্চল্যকর একটি বইয়ে। বইটিতে ব্রিটিশ ভারতের ডেপুটি পুলিশ ইন্স্পেকটর-জেনারেল ডালি পুলিশ সদস্যদের অপরাধী ধরতে সাহায্য করার জন্য বাংলা অঞ্চলের কিছু গোত্রের মানুষকে অপরাধী জাতি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তাদের চরিত্র, বৈশিষ্ট্যসহ। এই বইটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চারই ধারাবাহিকতা। যা ভেলাম ভান সেন্দেলের মতকে সমর্থন করে দারুণভাবে।
“ঔপনিবেশিক শক্তির মুখোমুখি” এখানে মোগল সাম্রাজ্য থেকে বৃটিশ সাম্রাজ্য ও দেশভাগ এবং জনসংখ্যার বিনিময় পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে, মোগল সাম্রাজ্য ও বৃটিশদের ঔপনিবেশিক শক্তির পার্থক্য আছে, মোগলরা যেখানে ক্রমাগত এখানকার সংস্কৃতির বিনিময় ও অর্থনীতিকে সম্মৃদ্ধ করেছে, ব্রিটিশরা তার উল্টো করেছে, তাই সেন্দালের এই অংশটি এত সরলরৈখিকভাবে পড়ার সুযোগ নেই পাঠকদের।
ভেলাম ভান সেন্দেলের বাংলাদেশ জনপদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বইটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত, প্রথম ভাগ “বৃহৎ চিত্রপট”-এ তিনি এই জনপদের সাধারণ একটি রূপচিত্র দাঁড় করিয়েছেন। দ্বিতীয় ভাগ, “ঔপনিবেশিক শক্তির মুখোমুখি” এখানে মোগল সাম্রাজ্য থেকে বৃটিশ সাম্রাজ্য ও দেশভাগ এবং জনসংখ্যার বিনিময় পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে, মোগল সাম্রাজ্য ও বৃটিশদের ঔপনিবেশিক শক্তির পার্থক্য আছে, মোগলরা যেখানে ক্রমাগত এখানকার সংস্কৃতির বিনিময় ও অর্থনীতিকে সম্মৃদ্ধ করেছে, ব্রিটিশরা তার উল্টো করেছে, তাই সেন্দালের এই অংশটি এত সরলরৈখিকভাবে পড়ার সুযোগ নেই পাঠকদের।
তৃতীয় ভাগ, “পূর্বপাকিস্তান হয়ে ওঠা” এটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্যোগ থেকে নব্য অভিজাত ও সাংস্কৃতিক নবায়ন পর্যন্ত বিস্তৃত। চতুর্থ ভাগ, “মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের জন্ম” এটি সশস্ত্র যুদ্ধ থেকে “নতুন জাতির মানসমূর্তি” পর্যন্ত ইতিহাসের বয়ান। আর পঞ্চম ভাগে রয়েছে, “স্বাধীন বাংলাদেশ” এখানে রাজনীতির নতুন রূপনির্মাণ ও জাতিগঠনে পরিচয়বাদের বিষয়টি আলোচনা করেছেন তিনি নিরপেক্ষভাগে, এখানে তিনটি ঐতিহাসিক প্রবন্ধের নাম যেমন, “সম্মৃদ্ধি নাকি ধ্বংস?” “জেন্ডার আন্দোলন” “একটি জাতীয় সংস্কৃতি?”, নতুন দেশের জাতীয় সংস্কৃতির নির্মাণ কোন পথে এগিয়েছে, সেখানে লিঙ্গসমতা, ও নতুন দেশটি কি আদৌ সম্মৃদ্ধির পথে যাওয়ার লক্ষ্যবিন্দু খুঁজে পেয়েছে, সেসবের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন তিনি।
উপসংহারে ১৯৪৭ পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের তালিকা ও গ্রন্থপঞ্জি যুক্ত করা হয়েছে। আর বইয়ের শুরুতেই, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্লেট, মানচিত্র ও সময়রেখা রয়েছে। “সময়রেখা” শুরু হয়েছে খ্রীস্টপূর্ব ৪০০০০ সাল থেকে। যেটি এই ভূমির প্রাচীনত্বের বিষয়টিকে ধারণ করে।
ঔপনিবেশিককাল থেকে স্বাধীনতার সময়পর্ব নিয়ে অনেক বই লিখিত হয়েছে, তবে শুধুমাত্র বাংলাদেশকে কেন্দ্রে রেখে ইতিহাস রচিত হয়েছে হাতে গোনা। ভেলাম ভান সেন্দেলের বাংলাদেশ জনপদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বইটি সেখানে এক বড় সংযোজন। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও বুদ্ধিবৃত্তির সততাও কাজটিকে অন্য উচ্চতা দিয়েছে।
বাংলাদেশ জনপদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
লেখক : ভেলাম ভান সেন্দেল
বিষয় : ইতিহাস
প্রকাশকাল : ২০২৪
প্রকাশক : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউ পি এল)
দাম : ৯৩০ টাকা।
বাংলাদেশ জনপদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বইটি কিনতে চাইলে
