বাহিরানা

বারকি, জন বারকি বই রিভিউ—উজ্জ্বল মেহেদী—এক ইংরেজের মধ্যে মিশেছে বাংলা


মনোয়ার পারভেজ

সুনামগঞ্জ শহর থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি যেতে তখন সরাসরি কোনো সড়ক যোগাযোগ ছিল না। সুরমা পাড়ি দিয়ে ধোপাজান চলতি নদী হয়ে প্রায় ত্রিশ মিনিটের নৌকাযোগে সাহেব বাড়ি ঘাট থেকে মণিপুরী ঘাটে যেতে হতো। পাড়ি দিতাম খোলা ইঞ্জিন নৌকায়।

খোলা ইঞ্জিনের নৌকায় পাড়ি দিতে দিতে অবলোকন হতো নদীর চারপাশ ও নদীকে ঘিরে শ্রমিক-মজুরের জনজীবনের হালচাল। সে চিত্রের দুইটা বিষয় আমাকে সবসময় আলাদা ভাবে আকর্ষণ করতো। এক, কারফো জাহাজ থেকে মজুরদের মালামাল ওঠা-নামার দৃশ্য। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সারি সারি “বারকি” নৌকা। আকৃতিতে ছোট এই নৌকাটি আঞ্চলিক ভাবে “বারকি নাও” বলেই প্রচলিত।

জাহাজ থেকে শ্রমিকদের জলে জল্লুশ হয়ে মালামাল নামানোর দৃশ্য চিহ্নিত করেন জন। হঠাৎ একদিন দেখেন নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছে একটা কাঠের টুকরো। সেটার উপরে বসে আছে একটি শকুন। এই দৃশ্য দেখে তার ভাবনায় হয়ে যায় নৌকা তৈরির সূত্রপাত। যেই ভাবনা সেই কাজ। তার আবিষ্কৃত ছোট আকৃতির এই নাও পছন্দ হয় শ্রমিকদের। ফলে দ্রুতই এর সংবাদ প্রচার হতে থাকে এলাকায়, এলাকায়।

নৌকাযোগে যাবার পথে একে দেখতাম। ভালো লাগত। বালু-পাথর টানায় এ নাওয়ের ব্যবহার প্রচুর। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমে হাওরে মাছ শিকারেও এই নাও দেখা যায়। বলা যায় শৈশব থেকে বড় হয়েছি এই নৌকা দেখে ও চড়ে।
এই নাও’য়ের নাম ‘বারকি’ আঞ্চলিক ভাবেই মনে গেঁথে গেছে। তাই কখনও জানতে ইচ্ছে হয়নি ‘বারকি’ কেন এর নাম ‘? আর কে-ইবা এর জনক? এটা অকপটেই স্বীকার করছি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে একদিন চোখে পড়ে সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদী’র “বারকি, জন বারকি” বইটির প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদে বারকি’র চিত্র ফুটে ওঠে। নামে ও চিত্রে চিনে ফেলি লেখক এখানে কিসের কথা বলছেন। আগ্রহ জাগে আরো বিস্তারিত জানার। এই নৌকা নিয়ে আবার কোন কাহিনি লুকিয়ে আছে? সাথে সাথে রকমারি থেকে বইটার কিছু অংশ পড়ে নিই। এবং বইটা সংগ্রহের তালিকায় রাখি। কিন্তু সংগ্রহ করা আর হয়ে ওঠেনি। ততোদিনে উজ্জ্বল ভাইয়ের সঙ্গেও পরিচয়। সেই সুবাদে তার কাছ থেকেই উপহার পেয়ে যাই বইটা।

সুতরাং এবার আসা যাক ‘বারকি’র সূত্রপাতের খোঁজে। বারকি ও এর শ্রমিকদের ঘিরে জনজীবনের চিত্র খুব কাছ থেকে দেখা হলেও কখনও ভাবিনি এ নিয়ে এক উপাখ্যান লিখে ফেলা যায়। কিন্তু উজ্জ্বল মেহেদী এই কাজটা করে ফেলেছেন। সাংবাদিকতা কাজের সূত্রে খুঁজে বেরিয়েছেন এর তত্ত্ব ও তথ্য। জানতে পারলাম, তার প্রায় ২৫ বছরের সাধনায় ফসল বইটি। পাঠ শেষে যখন লেখককে এর তথ্যসূত্র নিয়ে প্রশ্ন করি তখন তিনি বলে ওঠেন, “সবে তো মাত্র শুরু”। অর্থাৎ আরও উপাখ্যান বাকী আছে। ফলে, আমাদেরও জানার আছে।

এবার সারসংক্ষেপে বইটির কিছু আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ভারত উপমহাদেশে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে। সেসব ইতিহাস অবশ্য আমাদের কম জানা নয়। সেসময়ে মেঘালয়ের কোলঘেঁষা এই জলতল্লাটে আগমন ঘটে এক ব্রিটিশের। নাম “জন বারকি”। তার কিছু কারিগরিবিদ্যা জানা ছিল। এখানে তিনি সেই কাজ ও সঙ্গে আশ্রয় খুঁজতে থাকেন। জনমনে কিছুটা “ব্রিটিশ” ভীতি, তাই সহজেই তাকে কেউ কাজ ও আশ্রয় দিতে চায় না। অবশেষে রাজি হলেন ইয়ার মিয়া নামের এক স্থানীয় চুনাম ব্যবসায়ী। তার বাসায় আশ্রয় হয় জন-এর।

জাহাজ থেকে শ্রমিকদের জলে জল্লুশ হয়ে মালামাল নামানোর দৃশ্য চিহ্নিত করেন জন। হঠাৎ একদিন দেখেন নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছে একটা কাঠের টুকরো। সেটার উপরে বসে আছে একটি শকুন। এই দৃশ্য দেখে তার ভাবনায় হয়ে যায় নৌকা তৈরির সূত্রপাত। যেই ভাবনা সেই কাজ। তার আবিষ্কৃত ছোট আকৃতির এই নাও পছন্দ হয় শ্রমিকদের। ফলে দ্রুতই এর সংবাদ প্রচার হতে থাকে এলাকায়, এলাকায়। যেহেতু এর আবিস্কারক জন বারকি, তাই তার নামেই হয় এই নৌকার নাম। আর এভাবেই আমাদের পরিচয় ঘটে, উজ্জ্বল মেহেদীর মধ্যস্থতায় নৌকাটির আবিষ্কারকের সঙ্গে। কিন্তু কাহিনি এখানেই শেষ হয় না। শুরু হয় নৌকাটি নিয়ে জন বারকির আরেক বিপ্লব। সে নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা আছে এই গ্রন্থে। তবে ব্রিটিশ শাসন শুধু যে শোষণই করে গেছে তা নয়, কিছু কিছু হলেও দিয়ে গেছে। তারই উদাহরণ এই নৌকা।

কিন্তু নৌকার আবিষ্কারকের সঙ্গে যা ঘটেছিল তা খুবই করুণ। শুধুমাত্র এই জল তল্লাট নয়, বুকে নিদারুণ চাপা কষ্ট নিয়ে তাকে এই ভূমি ছেড়েই ফিরে যেতে হয়েছিল পিতৃপুরুষের দেশে। লেখক খুঁজে বেড়িয়েছেন সেসব ঘটনা। বারকি, বারিকপুর, বারেকের টিলায় যুগসন্ধি করেছেন তিনি জন বারকির। এই সন্ধি কোনো কল্প জগতের নয়। এর জন্য খোঁজ চালিয়েছেন শিলং হয়ে শুভলং অরণ্য পর্যন্ত। বারকি তত্ত্বের সূত্রপাত হয়েছে প্রায় ৩০০ বছর হবে। এতবছর বছর পরে এসেও উপাখ্যানটি এখনো প্রাসঙ্গিক। এর সঙ্গে যুক্ত মেঘালয় পাহাড় বেয়ে আফিম চালান থেকে বর্তমানে সীমান্ত পেরিয়ে চোরাচালান—সবই যেন প্রাসঙ্গিক। তাই বারকি ঘিরে জলখেলা এইসব তথ্য জানতে ও জানাতে “জলজোছনার জলোপাখ্যান” সিরিজের “বারকি, জন বারকি”র উদ্ভব।

বারকি, জন বারকি
লেখক : উজ্জ্বল মেহেদী
বিষয় : ইতিহাস, জীবনীগ্রন্থ
প্রকাশকাল : ২০২৩
প্রকাশক : চৈতন্য
দাম : ৫০০ টাকা। 

বইটি কিনতে চাইলে:

বারকি, জন বারকি (Barki, Jhon Barki) – বাহিরানা

(Visited 21 times, 1 visits today)

1 thought on “বারকি, জন বারকি বই রিভিউ—উজ্জ্বল মেহেদী—এক ইংরেজের মধ্যে মিশেছে বাংলা”

  1. অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের একটি আলোচনা।
    যা জলজোছনার এলাকার কিছু তথ্যের জ্ঞান অর্জন করা সহজ করে দেয়।
    ধন্যবাদ এমন তথ্যের জন্য 🥰

    Reply

Leave a Comment