বাহিরানা

দৃষ্টিপ্রদীপ বই রিভিউ—বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়—গদ্য কুশলতা ও মধ্যবিত্তের অনিশ্চিত জীবন


দিপু চন্দ্র দেব

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী সৃষ্টি আরণ্যক, পথের পাঁচালি উপন্যাসের মতো না হলেও “দৃষ্টিপ্রদীপ” তার ভালো রচনা। কোনো ভালো সাহিত্যবস্তুর একটি মানদণ্ড হতে পারে এর পাঠযোগ্যতা, সেই হিসেবে উপন্যাসটি যেহেতু এখনও মানুষ পড়ে চলেছে তাই একে সময়োত্তীর্ণ বলা যায়। আমাদের এখানে এধরণের বইগুলোর অনেক সংস্করণ প্রকাশিত হয়, যার বেশিরভাগই নিম্নমানের ছাপা। তবে, ভালো প্রকাশনাও হয়, যেমন আলোচ্য বইটির বর্তমান সংস্করণ প্রকাশ করেছে পাঠক সমাবেশ। তাদের বইয়ের মান বরাবরই এতেও বিদ্যমান।

এই বর্ণনাটিতে তিনি মায়ের উল্লেখে কী অবলীলায় পরিবেশের সুনিপুণ বিস্তার নিয়ে এলেন। আর বাক্যগঠনে তার দক্ষতা সে তো প্রশ্নাতীত। ধারাবাহিক সুরে গতানুতিক শব্দগুলো তাদের অন্তর্গত লাবণ্য দৃশ্যমান করে তোলে।

উপন্যাসের কাহিনি জিতু নামের এক চরিত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তার বাবার চাকরি চলে যাওয়া, এরপর জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া। ভাইয়ের মৃত্যু, বৈষ্ণবী মালতীর সঙ্গে সম্পর্ক, তাতেও অসুখী হওয়া—এসব ঘটনারাশিতে তার জীবন অতিবাহিত হয়।

এসবই খুবই সাধারণ বিষয় আশয়, পড়তে পড়তে এরকমই মনে হয়। কিন্তু বিভূতিভূষণের বিশেষত্ব অন্য জায়গায়, তিনি গতানুগতিকতার মধ্যেই মধ্যবিত্ত্বের স্থানচ্যুতির ভয়কে দৃশ্যমান করে তুলেছেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তিনি এই সাধারণ জীবনের দিকেই তাকিয়েছেন, যে জীবন স্থির হতে পারে না। কী এক অনিশ্চয়তা তাকে ঘিরে থাকে, নড়তে-চড়তে দেয় না, তবু তাকে অপার ভবিষ্যৎ ডাকে। ব্যতিব্যস্ত করে রাখে, যেন দুঃখের স্থানুত্ব তাকে অনুভব করতে না হয়।

উপন্যাসটির আরেকটি বিশেষত্ব হলো এর গদ্য, প্রাত্যহিক ভাষার মধ্যে বিভূতিভূষণ তার নিজস্ব চাল ঢুকিয়ে দিয়েছেন, তাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানে এই ভাষা। একটি উদাহরণ দেখা যেতে পারে:

“মায়ের দুঃখও এ বাড়িতে কম নয়। অত খাটুনির অভ্যেস মায়ের ছিল না কোন কালে। এই শীতকালে মাকে গোছা গোছা বাসন নিয়ে ভোরে পুকুরের জলে নামতে হয়, মা’কে আর তাকে। খিড়কি পুকুরের জল সকালে থাকে ঠাণ্ডা বরফ, রোদ তো পড়ে না জলে কোন কালেই, চারিধারে বড় বড় আম আর সুপুরির বাগান।”

এই বর্ণনাটিতে তিনি মায়ের উল্লেখে কী অবলীলায় পরিবেশের সুনিপুণ বিস্তার নিয়ে এলেন। আর বাক্যগঠনে তার দক্ষতা সে তো প্রশ্নাতীত। ধারাবাহিক সুরে গতানুতিক শব্দগুলো তাদের অন্তর্গত লাবণ্য দৃশ্যমান করে তোলে। বইটি জীবনের অচলতার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ, যেমনটি আমরা পথের পাঁচালিতে দেখেছি, এখানে অবশ্যই অন্য আখ্যানে সেই জীবন প্রকাশিত হয়েছে। তাই বইটি আমাদের মধ্যে নিজের স্থান করে নিয়েছে বিভূতিভূষণের গদ্য ও চরিত্র নির্মাণের কুশলতায়।

দৃষ্টিপ্রদীপ
লেখক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিষয় : উপন্যস
প্রকাশকাল : ২০২৪
প্রকাশক : পাঠক সমাবেশ
মূল্য : ২৭৫ টাকা।

বইটি কিনতে চাইলে:

দৃষ্টিপ্রদীপ – বাহিরানা

(Visited 6 times, 1 visits today)

Leave a Comment