বাহিরানা

সৈয়দ ফায়েজ আহমেদের অনুবাদে এদোয়ার্দো গালিয়ানোর ফুটবল: ইতিহাসের খণ্ডচিত্র — কবির চোখে দেখা


ফুটবল ইতিহাস মানব সমাজের ইতিহাসের চেয়ে ভিন্ন নয়, বরং অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। কারণ এই খেলাটি সভ্যতার সূচনা লগ্নের মানুষের দলবদ্ধতার বর্তমান শিল্পরূপ। কারণ এখানে হিংস্রতা আর লক্ষ্য আছে ঠিকই কিন্তু সেটি কঠোর নিয়ম মেনে, ঠিক যেন শেক্সপিয়ারের সনেট। জমাট নিয়মে বাঁধা কিন্তু মর্মের মাঝে ঝরণা আর বসন্তের উপচে পড়া সুষমা। এদোয়ার্দো গালিয়ানো কথাসাহিত্যিক,  বিপ্লবী, সাংবাদিক এবং ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে সার্থক লেখক।

পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা যদি ফুটবল হয়ে থাকে, তবে একে নিয়ে লেখা সবচেয়ে গভীরতম এবং জনপ্রিয় বইগুলোর একটি হলো আমাদের আলোচ্য বই সৈয়দ ফায়েজ আহমেদের অনুবাদে এদোয়ার্দো গালিয়ানোর ফুটবল: ইতিহাসের খণ্ডচিত্র। গালিয়ানোর মূল বইটির ইংরেজি সংস্করণের নাম ফুটবল ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো। এদোয়ার্দো গালিয়ানোকে খেলাটির কবি বিবেচনা করা হয়। শুধু ফুটবলই নয়, এই মহাকাব্যিক বইটি রাজনীতি আর নিপীড়িত মানুষের গল্পও।

ঘটনাবলীর সমষ্টিতেই ফুটবল, বইটিতে ম্যারাডোনা থেকে ইয়োহান ক্রইফ যেমন এসেছেন, তেমনি বিশ্বকাপ থেকে অলিম্পিকও এসেছে। তবে “গোল” হচ্ছে খেলাটির প্রাণবিন্দু, আমরা ম্যারাডোনার গোল তো কিংবদন্তিতে পরিণত হতে দেখেছি। কিন্ত আরো সব গোল আছে যেগুলো গুরুত্ববিচারে ম্যারাডোনার গোলের চেয়ে কম নয়, যদি স্বতন্ত্রভাবে কাল ও দেশ বিবেচনা করে দেখা যায়। এরকম কয়েকটি অবিস্মরণীয় গোলের বর্ণনা আমরা পাই বইটিতে

ফুটবলকে শিল্প বিবেচনা করা হয়, তাই গালিয়ানোর ফুটবল: ইতিহাসের খণ্ডচিত্র বইয়ের শুরু হয়, ফুটবল, খেলোয়ার, গোলকিপার, নামে তিন অধ্যায় দিয়ে। কারণ এরাই এর কুশীলব। এরপর আসে বিগ্রহ, সমর্থক যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ফ্যান, এরপরের অধ্যাটিরই নাম ফ্যানাটিক যারা গণ্ডগোল পাকাতে মাঠে আসে। এখানে বলা শিল্প শব্দটির গালিয়ানোর ব্যাখ্যা প্রয়োজন, তিনি ফুটবল নামের অধ্যাটিতে বলছেন, “ফুটবল খেলার ইতিহাস হচ্ছে নন্দন থেকে বন্ধনের এক বিষাদযাত্রা। যখনই খেলাটি পরিণত হলো ইন্ডাস্ট্রি তথা শ্রমশিল্পে, তখনই খেলার আনন্দ থেকে যে সৌন্দর্য ফুটে ওঠে, একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা হয় তা।” (ফুটবল: ইতিহাসের খণ্ডচিত্র)।

এর পেছনে থাকা পুঁজির রূপটিকে প্রকাশ করতে বলেন, “আমাদের এই আধুনিক যুগে, যা কিছু প্রয়োজনীয়, তাকেই খারিজ করে দেয় পেশাদার ফুটবল। আর অপ্রয়োজনীয়ের সংজ্ঞা তো আমরা জানিই—যা কিছু থেকে টাকাপয়সা কামানো যায় না।” (ঐ) ক্লাব ফুটবলের ভক্তরা হয়তো তার বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু ক্লাব খেলোয়াড়দের পেছনে বিরাট বিনিয়োগ করে, ফলে তাদের লগ্নিকৃত টাকা তুলে আনতে হয় সেই খেলোয়াড়দের মাধ্যমেই।

ঘটনাবলীর সমষ্টিতেই ফুটবল, বইটিতে ম্যারাডোনা থেকে ইয়োহান ক্রইফ যেমন এসেছেন, তেমনি বিশ্বকাপ থেকে অলিম্পিকও এসেছে। তবে “গোল” হচ্ছে খেলাটির প্রাণবিন্দু, আমরা ম্যারাডোনার গোল তো কিংবদন্তিতে পরিণত হতে দেখেছি। কিন্ত আরো সব গোল আছে যেগুলো গুরুত্ববিচারে ম্যারাডোনার গোলের চেয়ে কম নয়, যদি স্বতন্ত্রভাবে কাল ও দেশ বিবেচনা করে দেখা যায়। এরকম কয়েকটি অবিস্মরণীয় গোলের বর্ণনা আমরা পাই বইটিতে, যেমন, ১৯৬২ সালের ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনার ম্যাচে ববি চার্লটনের গোল, “জিজিনহোর গোল” “পেলের গোল” “গারিঞ্চার গোল”সহ আরো অনেকগুলো। যারা নিজ মহিমায় ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বকাপ নিয়ে লেখাগুলোর শুরু হয়েছে, ১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপ থেকে, এবং সেটি চলেছে একদম ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। এ এক বাড়তি পাওয়া।

ফুটবলের সাথে কিভাবে জাতীয়তা ও শোষণ জড়িয়ে আছে, তার সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ কয়েকটি লেখা আমরা পাই গালিয়ানো কাছে, যেমন, “জনতার আফিম?” “উদ্ধত পতাকা” “কালোরা” নামের অধ্যায়গুলোতে। লেখাগুলো পাঠকদেরকে ফুটবল খেলা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। গালিয়ানোকে একজন ঔপন্যাসিক ও ঐতিহাসিক হিসেবে সারাবিশ্ব যতটা জানে তত জানে না ফুটবল ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’র লেখক হিসেবে। কিন্তু ক্রীড়া সাহিত্যের পাঠকেরা জানেন এই একটিমাত্র বই কতখানি গুরুত্ববহ। এর তুলনা সে নিজেই।

সৈয়দ ফায়েজ আহমেদের অনুবাদে এদোয়ার্দো গালিয়ানোর ফুটবল ইতিহাসের খণ্ডচিত্র বইটিতে বাংলা ক্রীড়া সাহিত্যের রসগ্রহীতারাসহ সাধারণ পাঠকেরাও গালিয়ানোর হীরকতুল্য লেখার স্বাদ পাবেন। আর তাকে কেন ফুটবলের কবি বলা হয় তার প্রমাণ দেবে ফুটবল: ইতিহাসের খণ্ডচিত্র বইয়ের এই লেখাগুলো, “মাঠের মৃত্যু” “ক্ষুদ্র অঙ্গুরীয়” “তাবিজ ও জাদুমন্ত্র” “নিখুঁত চুমু অদ্বিতীয় হয়ে উঠতে চায়” মানে বলতে চাইছি পুরো বইটিই। আর বাংলাদেশের ফুটবল খেলার ইতিহাসের খুটিনাঁটি জানতে গালিয়ানোর ফুটবল: ইতিহাসের খণ্ডচিত্র বইটির রিভিউয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ছাড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের ফুটবল শিরোনামে বইয়ের রিভিউও পড়তে পারেন।

ফুটবল: ইতিহাসের খণ্ডচিত্র
লেখক: এদোয়ার্দো গালিয়ানো
অনুবাদ: সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ
বিষয়: ক্রীড়া 
প্রকাশনী: প্রথমা প্রকাশন
প্রকাশকাল: ২০২২
মূল্য: ৪৫০ টাকা।

ফুটবল: ইতিহাসের খণ্ডচিত্র বইটি কিনতে চাইলে


মন্তব্য করুন