বাহিরানা

জীবনে কিছু ভুল অনিবার্য এবং প্রয়োজনীয়: সাক্ষাৎকারে হারুকি মুরাকামি


জাপানি ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হারুকি মুরাকামি তার সর্বশেষ উপন্যাস “দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস” প্রকাশের পর এনপিআর (National Public Radio, NPR)কে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ১১ নভেম্বর, ২০২৪ সালে। মুরাকামি তার দৃষ্টিভঙ্গি, লেখার শৈলি নিয়ে ভাবনা, সঙ্গীত—বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন দিপু চন্দ্র দেব।


হারুকি মুরাকামির জন্য তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাসটি শেষ করা ছিল “বিপুল স্বস্তির”
অ্যান্ড্রু লিম্বং

“দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস” হলো “কিলিং কমেন্ডাটোর”-এর পর মুরাকামির প্রথম উপন্যাস।
আলভারো ব্যারিয়েন্টোস/এপি

“দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস”-এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা কঠিন। এটি শুরু হয় একজন মানুষের গল্প দিয়ে, যার কাজ হলো স্বপ্ন পড়া। সেই স্বপ্নগুলো সংরক্ষিত থাকে একটি লাইব্রেরির বইয়ের তাকে। আর সেই লাইব্রেরিটি অবস্থিত একটি শহরে, যা একজন দ্বাররক্ষীসহ একটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা যে সেটির প্রবেশপথের দিকে নজর রাখে। ওহ, আর প্রত্যেক মানুষের একটি করে ছায়া রয়েছে—যা তার…হোস্ট? উৎস? ব্যক্তি থেকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে?

এটি হারুকি মুরাকামির ছয় বছরের মধ্যে প্রথম উপন্যাস। আর আসলে এটি ১৯৮০ সালে তার লেখা একটি নভেলায় পুনর্গমন। একজন অনুবাদকের মাধ্যমে ইমেইলে করা একটি সাক্ষাৎকারে, তিনি এই নতুন বইয়ের পেছনের অনুপ্রেরণা, বয়স বাড়ার অনুভূতি এবং “দ্য গ্রেট গ্যাটসবি”-এর প্রতি তার অটুট ভালোবাসা নিয়ে কথা বলেছেন।

অ্যান্ড্রু লিম্বং: “দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস”-এর উৎস রয়েছে ১৯৮০ সালে আপনার লেখা এবং প্রকাশিত একটি ছোট গল্পে। এই উপন্যাসটি আপনার আগের লেখা বই “হার্ড-বয়েল্ড ওয়ান্ডারল্যান্ড অ্যান্ড দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড”-এর সাথেও যুক্ত। কয়েক দশক পূর্বে লেখা কাজগুলো পুনরায় দেখার সময় আপনি কী অনুভব করেন?

মুরাকামি: ১৯৮০ সালে লেখা নভেলা “দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস” হলো আমার একমাত্র কাজ, যেটিকে আমি পুনর্মুদ্রণের অনুমতি দিইনি। এটি একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু আমি বই আকারে প্রকাশ হতে দিইনি। কারণ হলো, যখন এটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল, আমি অনুভব করেছিলাম যে এটা এখনও অপক্ক এবং অপরিণত। সেই গল্পে আমি যে বিষয়টি অন্বেষণ করেছিলাম, তা আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং আমি যা লিখেছিলাম, তা বলা যেতে পারে একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আমার সূচনাবিন্দু। সমস্যা ছিল, সেই সময় আমি গল্পটি যেভাবে প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম, তার জন্য প্রয়োজনীয় লেখার দক্ষতা আমার ছিল না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যে, প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা এবং লেখার দক্ষতা অর্জন করার পর আমি এটিতে ফিরে যাব এবং সম্পূর্ণ পুনর্লিখন করব।

তবে এরই মধ্যে অন্যান্য প্রকল্প আসে, যা আমি হাতে নিতে চেয়েছিলাম, এবং প্রায় ৪০ বছর কেটে যায় (এক ঝলকেই মনে হয়) সেই গল্পে ফিরে কাজ না করেই। তখন আমার বয়স ৭০-এর কোঠায়, এবং আমি ভাবছিল যে আমার আর তেমন বেশি সময় বাকি নেই। তাই এখন একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে এই উপন্যাসটি লেখা শেষ করতে পারাটা আমার জন্য বিপুল স্বস্তির। আমি মনে করি যেন আমার কাঁধ থেকে একটি বিশাল বোঝা নেমে গেছে। যদি আমি আরও ৪০ বছর বাঁচি, কে জানে—হয়তো আমি এটি আরেকবার পুনর্লিখন করব।

অ্যান্ড্রু লিম্বং: এই উপন্যাসে আপনি একাকীত্ব, আকাঙ্ক্ষা এবং প্রেম সম্পর্কে অত্যন্ত সুন্দরভাবে লিখেছেন। পরাবাস্তব (সুররিয়ালিস্ট), জাদুবাস্তব গল্পগুলি এই বিষয়বস্তুগুলোকে কীভাবে প্রকাশ করে যা বাস্তববাদী কথাসাহিত্য পারে না?

হারুকি মুরাকামি’র “দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসারটেইন ওয়ালস” বইয়ের প্রচ্ছদ।
হারুকি মুরাকামি’র “দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসারটেইন ওয়ালস” বইয়ের প্রচ্ছদ। Image From: Goodreads

মুরাকামি: আমি কখনওই আমার লেখার শৈলীকে পরাবাস্তব বা জাদুবাস্তব হিসেবে ভাবিনি। আমি কেবল সেই গল্পগুলি লিখি যা আমি লিখতে চাই, এবং এমন একটি শৈলীতে যা আমার জন্য উপযুক্ত। যখন আমি গল্প লিখি, এটি প্রাকৃতিকভাবে এগিয়ে যায়, যেমন ভূমির স্তরবিন্যাস অনুসরণ করে জল প্রবাহিত হয়। আমি কেবল এই প্রবাহটিকে শব্দে রূপান্তর করি, যথাসাধ্য বিশ্বস্ততার সাথে।

অ্যান্ড্রু লিম্বং: আপনি “দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস” লেখা শুরু করেছিলেন মার্চ ২০২০-এ, যখন আপনি খুব কমই বাইরে বের হতেন এবং বেশিরভাগ দিনই এই উপন্যাসে কাজ করতেন। আফটারওয়ার্ড-এ আপনি লিখেছেন, “সেই পারিপার্শ্বিক অবস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় এগুলোর কিছু অর্থ আছে। আমি তা হাড়ে হাড়ে টের পাই।” এখন কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়েছে, এই উপন্যাস লেখায় মহামারীর প্রভাব আপনি কীভাবে দেখেন?

মুরাকামি: এই উপন্যাসটি লেখার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শান্তি, নিরবতা এবং ধ্যানের প্রয়োজন ছিল। এবং, এটা আপনার দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে, যে, সেই দেয়াল দিয়ে ঘেরা শহরটিকে বিশ্বব্যাপী লকডাউনের একটি রূপক হিসেবে দেখা যেতে পারে। চরম বিচ্ছিন্নতা এবং একাত্মতার উষ্ণ অনুভূতি কীভাবে একসাথে সহাবস্থান করতে পারে? এটি এই উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।

অ্যান্ড্রু লিম্বং: ছায়ারা এই বইতে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। ছায়া এবং জোড়ার ধারণাগুলো কীভাবে আপনাকে সম্মোহিত করেছিল?

মুরাকামি: আমার উপন্যাসের প্রথম পুরুষে মূল চরিত্রগুলি, স্পষ্ট করে বললে, আসলে আমি নই, বরং সম্ভবত সেই আমি যা হতে পারতাম। সম্ভাবনার বহুমুখীতাকে অনুসরণ করা আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল, এবং বছরের পর বছর উপন্যাস লিখতে গিয়ে আমার কাছে এটি একটি প্রকৃত আনন্দের বিষয় যার অভিজ্ঞতা আমি পেয়েছি। সর্বোপরি, জীবনে আমরা কদাচিৎ নিজেদের ছাড়া অন্য কেউ হওয়ার সুযোগ পাই।

সম্ভবত মানুষ একক সত্তা নয়, বরং বিভিন্ন অংশে গঠিত যৌগিক সত্তা। এবং হয়তো প্রকৃত সত্তা এবং ছায়া পরস্পর বিনিময়যোগ্য—গল্প লিখতে গিয়ে প্রায়শই এই চিন্তাটি আমার মনকে আলোড়িত করে।

অ্যান্ড্রু লিম্বং: আপনার লেখা অন্য কোনো পূর্ববর্তী গল্প আছে কী, যেটায় পুনরায় ফেরার কথা আপনি ভাবেন?

মুরাকামি: না, এমন কিছু নেই। অবশ্যই এমন কিছু কাজ আছে যা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই, কিন্তু সেগুলো পুনরায় লিখতে ইচ্ছে করে না। যেসব কাজ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই, তার মধ্যে কিছু নিয়ে আমার আফসোস আছে, কিছু নিয়ে নেই। জীবনে কিছু ভুল অনিবার্য এবং প্রয়োজনীয়, আবার কিছু ভুল আছে যেগুলো শুধরানো দরকার।

অ্যান্ড্রু লিম্বং: আপনি লিখেছেন যে লেখালেখি সম্পর্কে আপনি যা জানেন, তা সবই সঙ্গীত থেকে শিখেছেন। যদি তা এখনও সত্য হয়, তাহলে আপনার জন্য নতুন সঙ্গীত আবিষ্কার করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? লেখালেখি সম্পর্কে এখনও কি সঙ্গীতের কাছ থেকে শেখার কিছু আছে?

মুরাকামি: তারুণ্যেই সঙ্গীত সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভূত হয়, যখন তা হৃদয় ও আত্মায় গভীরভাবে প্রবেশ করে। সাধারণত সময়কালটি আপনার কৈশোর থেকে বিশের দশক পর্যন্ত। যখন আমি সেই বয়সে ছিলাম, আমি অসংখ্য আশ্চর্য সঙ্গীত শুনেছি এবং তা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ শিখেছি। এখন…আমি কেবল ভালো সঙ্গীত শুনতেই পছন্দ করি।

অ্যান্ড্রু লিম্বং: গত কয়েক বছরের কিছু সাক্ষাৎকারে আপনাকে আপনার নারী চরিত্রগুলি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। আপনার মতে, কোন সমালোচনা বা উদ্বেগগুলো উঠে এসেছে সেখানে?

মুরাকামি: একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত আমি আমি সমালোচনা পড়া একেবারে বন্ধ করে দিয়েছি (এটি সত্য), এবং আমি দুঃখিত, সেই নির্দিষ্ট সমালোচনার প্রসঙ্গে আমি জানি না। সাধারণভাবে আপনি বলতে পারেন, একজন মানুষ হিসেবে আমার সীমাবদ্ধতা আছে, এবং সেভাবে আমার উপন্যাসেরও আছে। তাই এটা স্বাভাবিক যে কোনো বিষয়ের জন্য আমি সমালোচিত হয়েছি। যদি কেউ আমার কাজ উপভোগ করেন, তা আমাকে সুখী করে, অবশ্যই, কিন্তু যদি না করেন, তবে আমি কেবল যা করতে পারি তা হলো আমি তাদের বলতে পারি যে আমি দুঃখিত।

অ্যান্ড্রু লিম্বং: আপনি এফ. স্কট ফিটজেরাল্ডের বিশাল ভক্ত, এবং আমি জানি যে আপনি তাঁর কাজ অনুবাদ করেছেন। আগামী বছর ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’-র শততম বার্ষিকী। অনুবাদ করার পর বইটির সাথে আপনার সম্পর্ক ও বোঝাপড়া কীভাবে বদলেছে বা বেড়েছে?

মুরাকামি: “দ্য গ্রেট গ্যাটসবি” অনুবাদ করার সময় আমি খুব স্পষ্টভাবে অনুভব করেছি যে এই উপন্যাসে কিছুই যোগ করার নেই, আবার এর মাঝে কিছুই অসম্পক্তৃত বা বহিরাগত নয়। বলাই বাহুল্য, এমন গুণসম্পন্ন উপন্যাস খুব কমই আছে, এবং এটা ব্যাখ্যা করে কেন গত একশো বছর ধরে গ্যাটসবি সময়ের পরীক্ষায় টিকে আছে। এটি আদতেই একটি চমকপ্রদ, অসাধারণ কীর্তি। আমার জন্য, এই উপন্যাসটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অফুরন্ত আনন্দের উৎস ছিল।

অ্যান্ড্রু লিম্বং: আপনি এখন কী নিয়ে কাজ করছেন?

মুরাকামি: এটা একটি রহস্য।

 

(Visited 32 times, 1 visits today)

Leave a Comment