বাহিরানা

অবরোধ-বাসিনী বই রিভিউ—বেগম রোকেয়া—নারীর প্রতি দ্বৈত মানদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছিল যে বই


দিপু চন্দ্র দেব

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, একজন অগ্রগামী নারীবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং লেখিকা। দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য ও নারী অধিকার আন্দোলনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বেগম রোকেয়ার ‘অবরোধ-বাসিনী’ (১৯৩১ সালে প্রকাশিত) আজও একটি যুগান্তকারী রচনা, যা নারীর পর্দাপ্রথা’র সমালোচনার পাশাপাশি নারী মুক্তির নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উত্থাপন করেছিল। বইটির শিরোনাম ‘অবরোধ-বাসিনী’ অর্থাৎ “অবরোধে বসবাসকারী নারী”, এই অবরোধের বিপক্ষে বইটি এক শক্তিশালী ইশতেহার, যা তাঁর সময়ের সামাজিক নিয়মগুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং একইসাথে নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতার ধারণার বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে।

একটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে, বেগম রোকেয়া ‘অবরোধ-বাসিনী’ লেখেন সেই সময়ে যখন ঔপনিবেশিক ভারতের নারী, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের নারীরা প্রায়শই ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকত এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হত। তাঁর কাজ এবং সাহস ও স্পষ্টতা সেই সময়ের জন্য বৈপ্লবিক ছিল, কারণ গভীরভাবে প্রোথিত সামাজিক নিয়মগুলিকে চ্যালেঞ্জ করা চাট্টিখানি কথা নয়। রোকেয়া শুধু লেখেনইনি সামাজিক দায়বদ্ধতায়ও আবদ্ধ হয়েছিলেন, উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে, তিনি কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ভারতে মুসলিম মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুলগুলির মধ্যে একটি। 

বইটি ৪৭টি ছোট ছোট গল্প বা অনুগল্পের সংকলন, যেগুলোর মাধ্যমে তিনি পর্দাপ্রথার কারণে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ নারীদের জীবন তুলে এনেছেন। রোকেয়া তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ এবং মর্মস্পর্শী গল্প বলার মাধ্যমে এই ব্যবস্থার অবিচার ও অযৌক্তিকতা উন্মোচন করেন। তিনি যুক্তি দেন যে পর্দা শুধু শারীরিক বাধা নয়, এটি মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাধাও বটে, যা নারীর সম্ভাবনাকে চেপে রাখে এবং সমাজে তাদের যথাযথ স্থান থেকে বঞ্চিত করে।

বইটির একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হলো নারীর উপর চাপানো সমাজ-রাষ্ট্রের দ্বৈত মানদণ্ডের সমালোচনা। রোকেয়া তুলে ধরেন যে কীভাবে পুরুষরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে, শিক্ষা অর্জন করতে পারে এবং জনজীবনে অংশগ্রহণ করতে পারে, অন্যদিকে নারীদের গৃহকোণে আবদ্ধ রাখা হয়, প্রায়শই শিক্ষা বা ব্যক্তিগত বিকাশের সুযোগ ছাড়াই। তিনি পর্দার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক যুক্তিগুলিকে প্রশ্ন করেন এবং যুক্তি দেন যে এগুলি নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের ফল।

রোকেয়া নারীশিক্ষার গুরুত্বের উপরও জোর দেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষাই হলো নিপীড়নের শৃঙ্খল ভাঙার চাবিকাঠি এবং নারীকে স্বাবলম্বী ও সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যম। লেখার মাধ্যমে তিনি এমন একটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখেন যেখানে নারীদের ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাদের প্রতিভা বিকাশের এবং সমাজের উন্নতিতে অবদান রাখার স্বাধীনতা দেওয়া হয়।

তিনি তাঁর যুক্তি উপস্থাপনের জন্য ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ এবং হৃদয়গ্রাহী লিপিকুশলতার মিশ্রণ ব্যবহার করেছেন। তাঁর ভাষা সরল কিন্তু শক্তিশালী, যা তাঁর ধারণাগুলিকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে তোলে।
বইটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর সময়াতীত প্রাসঙ্গিকতা। যদিও পর্দাপ্রথা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে, নারীর প্রতি লিঙ্গ বৈষম্য, চলাফেরার সীমাবদ্ধতা এবং শিক্ষার সুযোগের অভাব—আজও বিশ্বের অনেক অংশে একটি জরুরি সমস্যা। রোকেয়ার কাজ আজও নারীবাদী ও সমাজ সংস্কারকদের অনুপ্রাণিত করে—যারা নারী অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করেন।

একটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে, বেগম রোকেয়ার অবরোধ-বাসিনী লেখার সময়পর্ব সেই সময়ে যখন ঔপনিবেশিক ভারতের নারী, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের নারীরা প্রায়শই ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকত এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হত। তাঁর কাজ এবং সাহস ও স্পষ্টতা সেই সময়ের জন্য বৈপ্লবিক ছিল, কারণ গভীরভাবে প্রোথিত সামাজিক নিয়মগুলিকে চ্যালেঞ্জ করা চাট্টিখানি কথা নয়। রোকেয়া শুধু লেখেনইনি সামাজিক দায়বদ্ধতায়ও আবদ্ধ হয়েছিলেন, উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে, তিনি কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ভারতে মুসলিম মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুলগুলির মধ্যে একটি। তাঁর জীবন ও কাজ—শিক্ষা ও নারী ক্ষমতায়নের শক্তিতে তাঁর বিশ্বাসের প্রমাণ।

অবরোধ-বাসিনী ইতোমধ্যেই ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে, একে বাংলাদেশ এবং এর বাইরেও নারীবাদী সাহিত্যের একটি মাইলফলক বলা যায়। বেগম রোকেয়ার সাহস, দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারী অধিকারের প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি এই বইয়ের প্রতিটি পাতায় উজ্জ্বল।
আজকের পাঠকদের জন্য বইটি একটি ঐতিহাসিক দলিল এবং অনুপ্রেরণার উৎস। বলা যায়, বইটি নারীবাদী সাহিত্য, সমাজ সংস্কার বা দক্ষিণ এশিয়ায় নারী অধিকারের ইতিহাসে আগ্রহী প্রত্যেকের জন্য অবশ্যপাঠ্য।

অবরোধ-বাসিনী
লেখক : বেগম রোকেয়া
প্রকাশকাল : ২০২৪
প্রকাশক : পাঠক সমাবেশ
মূল্য : ১৫০ টাকা ২০% ছাড়ে বাহিরানাতে ১২০ টাকা।

বইটি কিনতে চাইলে:

অবরোধ-বাসিনী (Oborudhbashini) – বাহিরানা


Leave a Comment