আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি (২০১৩) দিয়ে তাঁর খ্যাতি বহুল পরিমাণ বাড়লেও আকবর আলি খানের পরার্থপরতার অর্থনীতি বইটি ছিল তার খ্যাতির প্রথম সূচনাগ্রন্থ। এবং যতই দিন যাচ্ছে পরার্থপরতার অর্থনীতি নিজের গুরুত্ব বাড়িয়েই চলেছে। তিনি নিজে অর্থনীতির ছাত্র হওয়ায় এবং প্রশাসনিক কাজে যুক্ত থাকায় বাংলাদেশের জন্ম থেকে এর বিস্তার ও সীমাবদ্ধতা দেখেছেন। এটাও দেখেছেন যে, এখানে, অর্থনীতির সিদ্ধান্ত যারা নেন, তারা অর্থনীতিবিদ নন, আবার যারা অর্থনীতিবিদ তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্তরটিতে থাকেন না। ফলে, বহু বিবেচনায়ই সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রাজ্ঞজনদের মতামত প্রয়োগ করা হয় না। তবে, ২০০০ সালে প্রকাশিত এই বইটি যখন এখনও মানুষ পড়তে চাচ্ছে, এর থেকে এটা বোঝা যায় জ্ঞান বৃথা যায় না।
“গ্রেশামের সনাতন বিধির মত এটি মনে রাখা ভাল যে, উন্নয়নের জগতে একই কর্মসূচীতে যদি গরীবদের সাথে যারা গরীব নয় তাদের একত্রিত করা হয়, তবে যারা দরিদ্র নয় তারা দরিদ্রদের এবং যারা দরিদ্র তারা হতদরিদ্রদের বঞ্চিত করবে এবং এ পরিস্থিতি চলতেই থাকবে যদি প্রথমেই উপশমমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়। যা ঘটবে তা হল গরীবদের নামে যারা গরীব নয় তারা সকল সুবিধা ভোগ করবে।” Yunus, Muhammad, Bankar to the poor (Dhaka university press Ltd, 1999)
আমরা দেখেছি কোনো একটি দেশের ইতিহাসের কালপর্বে অর্থনীতির সিদ্ধান্তকে পর্যালোচনা করতে হয়। কারণ বর্তমান কাঠামোটি তখন আর কাজ করে না, আর ঠিক তখনই অতীতে এই সমস্যাটি নিয়ে যারা আলোকপাত করেছিলেন তাদের কাছে ফিরতে হয়। আকবর আলি খানের পরার্থপরতার অর্থনীতি সেই তালিকাতেই পড়ে। কারণ এর আবেদন বাংলাদেশেকে সক্ষম করে তোলার প্রতি। এই বইটি যেমন বাংলাদেশের সমস্যায় মনোযোগ দিয়েছে তেমনি তার পরবর্তী বই ২০১৩ সালে প্রকাশিত আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি-তে তিনি বর্তমান সময়ের অর্থনীতির ভিন্নধর্মী কিছু গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। দুইটি বই একসঙ্গে একটা সামগ্রিকতা তৈরি করছে পাঠকদের জন্য।
আকবর আলি খানের পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে প্রবন্ধ রয়েছে ১৫টি। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াকে বোঝার জন্য বইয়ের নাম প্রবন্ধ পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দানের মধ্যে কী কোনো স্বার্থ আছে? রাজা হর্ষবর্ধনের দান-খয়রাত নিয়ে আলোচনা থেকে উন্নত বিশ্বের পক্ষ থেকে তৃতীয়বিশ্বে গরীবদের উন্নয়নের জন্য যে দান দেওয়া হয় তার উপযোগীতা কতদূর? এখানে আবার এ প্রশ্নটি আসে দাতাসংস্থাগুলো যে সাহায্যসহযোগীতা দেয় সেগুলোর কতটুকু গরীবদের হাতে যায়? আর সবচেয়ে বড় কথা এর ফলে দরিদ্রদের ভাগ্যের চাকা কতটুকু ঘোরে? আর দানের লক্ষ্যগুলো কী, কী? প্রবন্ধটিতে এরকম অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন লেখক। তবে সব বিবেচনা শেষে একটি সিদ্ধান্ত টেনেছেন তিনি, সেটির মূল বক্তব্য হলো, দান যেন গরীবদের ভাগ্যের উন্নতি ঘটায়, নাহলে সেটির সুফল পাওয়া যাবে না। প্রত্যেকের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আকবর আলি খান ড. মোহাম্মদ ইউনূসের আত্মজীবনী থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধিৃতি ব্যবহার করেছেন। উদ্ধিৃতিটিতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গরীবদের সঙ্গে গরীব নয় যারা তাদের যুক্ত করলে কী ঘটতে পারে তারই কথা রয়েছে, মূল বক্তব্যটি অর্থনীতিবিদ গ্রেশামের। এখানে সেটি পুরোটিই তুলে দিচ্ছি:
“গ্রেশামের সনাতন বিধির মত এটি মনে রাখা ভাল যে, উন্নয়নের জগতে একই কর্মসূচীতে যদি গরীবদের সাথে যারা গরীব নয় তাদের একত্রিত করা হয়, তবে যারা দরিদ্র নয় তারা দরিদ্রদের এবং যারা দরিদ্র তারা হতদরিদ্রদের বঞ্চিত করবে এবং এ পরিস্থিতি চলতেই থাকবে যদি প্রথমেই উপশমমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়। যা ঘটবে তা হল গরীবদের নামে যারা গরীব নয় তারা সকল সুবিধা ভোগ করবে।” Yunus, Muhammad, Bankar to the poor (Dhaka university press Ltd, 1999)
আমরা দেখতে পাই, ড. মোহাম্মদ ইউনূস ১৯৯৯ সালে আত্মজীবনীতে গ্রেশামের দরিদ্রদের নিয়ে যে ভাবনাটি উদ্ধৃত করেছিলেন সেটির সম্পূর্ণরূপ দিয়েছেন তার নিজস্ব দারিদ্র বিমোচন তত্ত্বে। তত্ত্বটি নিয়ে তিনি বিস্তারিত লিখেছেন ২০১৭ সালে প্রকাশিত তার A World Of Three Zeros (তিন শূন্যের পৃথিবী) বইয়ে।
এই কয়েকটি বাক্যে তিনি বাংলাদেশের সামগ্রিক হালচালই নিয়ে এসেছেন। তার উল্লেখিত পরিস্থিতি বর্তমান থাকায় দেশে কখনওই সঠিকভাবে বিদেশি সাহায্য সহযোগীতা কাজে লাগানো যায়নি। এখানে, দানের স্বার্থ ও গরীবের উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় রাখলে পুরো বইটি আত্মস্থ করা সহজ হবে।
আরেকটি প্রবন্ধ ““শুয়রের বাচ্চাদের” অর্থনীতি” এর মূল প্রতিপাদ্য হলো প্রশাসনের দুর্নীতি। আমাদের পিছিয়ে পড়ায় এর অবদান কম তো নয়ই বরং খুবই বৃহৎ। ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা মাইকেল ক্যারিটের অনুপ্রেরণায় লেখা এই প্রবন্ধটির বিস্তার সেই চাণক্যের অর্থশাস্ত্র পর্যন্ত।
“সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি” নামক প্রবন্ধে আছে, ““সংস্কারকে ব্যাভিচারের সাথে তুলনা করে জনৈক ব্যক্তি বলেছেন : “যারা ব্যভিচার করে তারা কখনও এ সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করে না, যারা পারে না তারাই এ নিয়ে ফরফর করে।” আকবর আলী খানের এই ব্যক্তির উল্লেখে নিজের বক্তব্য পেশ করায় দুইটি জিনিস আমাদের বর্তমান দেশের পরিস্থিতিকেও ভালোভাবেই ইন্ডিকেট করছে। এক, সংস্কার রাজনৈতিক, আবার তার অর্থনীতিও আছে। মানে রাজনৈতিক সংস্কারের ভালোমন্দ দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। এখন আমরা নিজেদের কতখানি বোধবুদ্ধি নিয়ে এই সংস্কারের সাথে বোঝাপড়া করব, তাতেই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।
রাজনীতি জনগণের, তাই তাদের সিদ্ধান্তই আসল হওয়ার কথা। যদিও আমাদের ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয় না। কিন্তু এর সাথে প্রবন্ধটির এই বাক্যটির দিকেও মনোযোগ দেওয়া ভালো হবে, “কিন্তু ভাল অর্থনীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাল রাজনীতি নয়। যে ধরণের সংস্কার ভোটারদের আকৃষ্ট করে না, সেই ধরণের সংস্কার রাজনীতিবিদ্দেরও আকর্ষণ করে না।” এই কথাটি ভালোভাবে ধারণ করতে পারলে সহজেই কোন দল বা ক্ষমতায় আসীন পক্ষ জনতুষ্টিমূলক কাজকর্ম করছে কী-না সেটি সহজেই ধরে ফেলা সম্ভব হবে বলে ধারণা করা যায়।
বাকি প্রবন্ধগুলোও এখানে উল্লেখিত প্রবন্ধগুলোর ধারাবাহিকতায় পুরনো সব সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছেন লেখক। সমস্যাগলো যে পুরনো সেটি প্রবন্ধগুলোর নামেই স্পষ্ট চিহ্নিত, যেমন এখানে কয়েকটি, “লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি” “শোষণের রাজনৈতিক অর্থনীতি” “শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অসাম্য”। এগুলো থেকে বেরোনোর পথ সন্ধান করেছেন তিনি। বিশেষ করে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য নিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের এই বৈষম্য খুবই ব্যাপক আকারে বর্তমান, তাই “লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি” প্রবন্ধটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এই তিনটি প্রবন্ধই একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, বৈষম্যমুক্তির জন্য যেমন অর্থনৈতিক অসাম্য ও শোষণ দূর করা প্রয়োজন, তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোনোটিই বাস্তবায়ন হবে না।
আকবর আলি খানের হিউমার অসাধারণ। তিনি এমনসব জটিল ইতিহাস এবং অর্থনীতিবিদদের উদ্ধৃতি ও তাদের কৃত সমস্যাচিহ্নিতকরণ হাজির করেছেন—তাও এমন সাধারণের বোধগম্য ভাষায় যে পণ্ডিত থেকে সাধারণ পাঠক সবার কাছেই অসাধাণ পাঠযোগ্যতা অর্জন করেছে বইটি। আর আমাদের নিজস্ব ভৌগৌলিক সমস্যাগুলোর কথা কথা না বললেই নয়, প্রতিবছরের বন্যা সেই সমস্যাগুলোর একটি। কে জানত যে, বন্যা নিয়েও রাজনীনৈতিক অর্থনীতি হয়? সেটি নিয়েও লিখেছেন তিনি “বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক অর্থনীতি” শিরোনামের প্রবন্ধে। বইটিতে প্রতি অধ্যায়েই তথ্যসূত্র নির্দেশ করেছেন লেখক এবং বইয়ের শেষে পরিভাষাকোষ যুক্ত করেছেন। এগুলো যারা আরো সব তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদদের লেখা পড়তে চান, তাদের উপকৃত করবে।
বাংলাদেশকে গড়তে আকবর আলি খানের পরার্থপরতার অর্থনীতি বইটির কাছে বারেবারেই ফিরতে হবে।
পরার্থপরতার অর্থনীতি
লেখক : আকবর আলি খান
বিষয় : অর্থনীতি
প্রকাশকাল : প্রথম প্রকাশ ২০০০, ২৩তম মুদ্রণ ২০২৩
প্রকাশক : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউ পি এল)
দাম : ৪০০ টাকা ২০% ছাড়ে ৩২০ টাকা।
পরার্থপরতার অর্থনীতি বইটি কিনতে চাইলে
