বাহিরানা

আসাম থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রিকা সাপ্তাহিক ‍মুক্ত বাংলা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল


১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিগর্ভ সময়ে সাপ্তাহিক মুক্ত বাংলা প্রতিরোধ ও তথ্যচিত্রের একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ শহর থেকে চার পাতার এই ট্যাবলয়েডটি প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসানাত এবং সিরাজুল ইসলাম। আসাম থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রিকা সাপ্তাহিক ‍মুক্ত বাংলা নিজেকে আলাদা করে তুলেছিল যুদ্ধের নৃশংসতা এবং সেইসাথে একটি জাতির স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের অদম্য চেতনার প্রত্যক্ষ বিবরণ দিয়ে। বর্তমানে বই আকারে প্রকাশিত পত্রিকাটির সংখ্যাগুলো সংগ্রহ, সম্পাদনা ও ভূমিকা লিখেছেন মোস্তফা সেলিম।

বাংলাদেশের বাইরে আসাম থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মুক্ত বাংলা’র সূত্রে আরেকটি পত্রিকার নাম নিতে হয়, পত্রিকাটি একদম যুদ্ধের ভেতর বাংলাদেশেই ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে সাপ্তাহিক অগ্রদূত পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো রংপুরের রৌমারি মুক্তাঞ্চল থেকে। আজিজুল নামে রৌমারির স্থানীয় এক শিক্ষক সেই উত্তাল বিপদজনক সময়ে পত্রিকাটি অসম সাহসে সম্পাদনা করতেন। আসামের করিমগঞ্জে সাপ্তাহিক মুক্তবাংলা যে নিরাপত্তার বলয় পেত তার কিছুই তখন বাংলাদেশের সাপ্তাহিক অগ্রদূত পত্রিকাটির ছিল না। তবু এও বলতে হয়, দুইটি পত্রিকাই সৎ ও বস্তুনিষ্ট সাংবাদিকতা করতে চেয়েছে, বস্তুনিষ্টতা ও সততা নিজেই যেহেতু কঠিনকঠোর, তাই নিরাপত্তা সবজায়গাতেই তার জন্য কম।

অন্যদিকে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে এই পত্রিকাটি ঘটনার রিয়েল-টাইম রেকর্ডার হিসেবেও কাজ করেছে, যেটি পত্রিকাটিকে যুদ্ধের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উৎসে পরিণত করেছে। সমসাময়িক অনেক প্রকাশনার থেকে আলাদা হয়ে “মুক্ত বাংলা” শুধু ঘটনাগুলোর প্রতিবেদনই দেয়নি; পাঠকদের অবরুদ্ধ মানুষের যন্ত্রণারও মুক্তি ঘটিয়ে আশার সঞ্চার করেছে তখন।

যুদ্ধের সবচেয়ে উত্তপ্ত মাসগুলোতে আসাম থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রিকা সাপ্তাহিক ‍মুক্ত বাংলা পত্রিকাটিকে একইসাথে সময়ের সাক্ষী ও ইতিহাসের স্মারক বলা যায়। এর পাতাগুলো—ছবি, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ এবং সম্পাদকীয়—পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নিপীড়নের ভয়াবহ বাস্তবতাকে ধারণ করে আছে। পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যাই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জোগাতে সাহায্য করেছে।

অন্যদিকে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের কাছাকাছি (করিমগঞ্জ বাংলাদেশের সিলেটের অংশ ছিল, দেশভাগের সময় করিমগঞ্জ ভারতের অংশে পড়ে যায়। এখনও সেখানে জনসংখ্যার অধিকাংশই সিলেটি) অবস্থানের কারণে এই পত্রিকাটি ঘটনার রিয়েল-টাইম রেকর্ডার হিসেবেও কাজ করেছে, যার কারণে পত্রিকাটি বর্তমানে যুদ্ধের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উৎসে পরিণত হয়েছে। আর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী ছিলেন সিলেট বিভাগের এবং করিমগঞ্জের সব সিলেটিদের আত্মীয়স্বজন তখন সিলেট বিভাগে ছিল, তা এখনও আছেন। সিলেট সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই বড় বড় রাজনৈতিক চিন্তক ও  রাজনীতিবিদদের অঞ্চল। ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা ও কংগ্রেস প্রতিষ্ঠাতাদের একজন বিপিনচন্দ্র পাল ছিলেন তখনকার সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার সন্তান। তাই স্বভাবতই মুক্তিযুদ্ধের সময় সমসাময়িক অনেক প্রকাশনার থেকে আলাদা হয়ে সাপ্তাহিক মুক্ত বাংলা যুদ্ধকালীন সাংবাদিকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। পত্রিকাটি অবরুদ্ধ মানুষের যন্ত্রণার সামান্য হলেও মুক্তি ঘটিয়ে আশার সঞ্চার করেছে তখন। পত্রিকাটি বিশাল কোনো প্রকাশনা নয়, কিন্তু এর দায় ছিল অনেক অনেক বেশী। দায়টি ছিল, করিমগঞ্জবাসী তখন ভাগ্যচক্রে আসামে পড়ে গেলেও আসাম তাদের জন্য বিজন প্রদেশ, সেখানে নেই দেশীদের কোলাহলরব। সিলেটে তখন তাদেরই জ্ঞাতিজন প্রাণ হারাচ্ছিল, এই দায় অস্বীকার করেনিনি তারা বরং  করিমগঞ্জবাসী কাধে তুলে নিয়েছিলেন সেই সত্যের ভার।

আসাম থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রিকা সাপ্তাহিক ‍মুক্ত বাংলা‘র সত্যনিষ্ঠতার কথাও বলা যায়। সেন্সরশিপ ও বিপদের মুখে সম্পাদকদের সত্য প্রকাশের অঙ্গীকার এই প্রকাশনাটিকে একটি নৈতিক ভিত্তি দিয়েছিল। তাই এটি এখন একটি ঐতিহাসিক দলিল, যা ১৯৭১ সালের মৌখিক ইতিহাস ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার এক বড় উৎস। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে করিমগঞ্জবাসী ঋণী করেছেন ভালোবাসায়, সাহসে, পাশে দাঁড়ানোর ভরসায়, এ সত্য অস্বীকার করার পথ নেই। গবেষকদের জন্য, বইয়ের দুই মলাটের ভেতর চলে আসা পত্রিকাটি যুদ্ধকালীন প্রচারণা, স্থানীয় পর্যায়ের সংগঠন এবং সংঘাতের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করবে বলা যায়। আর সাধারণ পাঠকদের জন্য তৈরি করবে অতীতের সাথে সেতুবন্ধন ।

সাপ্তাহিক মুক্ত বাংলা
সংকলন ও সম্পাদনা: মোস্তফা সেলিম
প্রকাশক: পাঠক সমাবেশ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪
মূল্য : ১৪৯৫ ২০% ছাড়ে ১১৯৬ টাকা।

বইটি কিনতে হলে:

সাপ্তাহিক মুক্ত বাংলা (Shaptahik Mukta bangla) – বাহিরানা


মন্তব্য করুন