বাহিরানা

ট্রেন টু পাকিস্তান বই রিভিউ—খুশবন্ত সিং—দেশভাগের জাদুবাস্তব ‍উপাখ্যান


দিপু চন্দ্র দেব

ব্রিটিশভারতের দেশভাগ নিয়ে যত সাহিত্য রচিত হয়েছে তার মধ্যে খুশবন্ত সিং-এর “ট্রেন টু পাকিস্তান” অন্যতম। বলা যায় সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের গভীরতা ও ব্যপ্তি, সম্পর্ক—যত ধরণের উপাদান দেশভাগের সঙ্গে যুক্ত তার সবই এই একটি উপন্যাসে পাওয়া যায়। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, একটু আগ বাড়িয়ে বললে বাংলা ভাষায় নতুন রূপ দিয়েছেন তিনি এই সাহিত্যবস্তুটির। বইটি প্রকাশ করেছিল নালন্দা, বর্তমান সংস্করণ প্রকাশ করেছে প্রকাশনী সংস্থা ঐতিহ্য।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মাকোন্দো গ্রামের জাদুবাস্তবতার নিদর্শন যেন লাশ ভর্তি হয়ে আসা ট্রেন। মার্কেজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার সব গল্পই বাস্তব। এর প্রমাণ পাওয়া যায় খুশবন্ত সিং-এর এই উপন্যাসে, যে বাস্তবও কেমন জাদুবাস্তব হয়ে উঠতে পারে।

উপন্যাসের কাহিনির কেন্দ্র, ১৯৪৭ সালে যখন ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেছে, তখন মানো মাজরা নামের একটি শান্ত গ্রাম, যেখানে মুসলিম এবং শিখদের আধিক্য। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের এক রেল স্টেশনের পাশের এই গ্রামটি কীভাবে অশান্ত হয়ে উঠে তারই বয়ান হাজির করেছেন খুশবন্ত সিং। গ্রামের অধিবাসীরা গান্ধীর ব্যাপারে কিছু জানলেও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে চিনে না। রাম লাল নামে সুধী কারবারীর বাড়িতে হঠাতই একদিন ডাকাতি হয়, রাম লালকে মেরে ফেলে ডাকাতরা। আর সেখান থেকেই পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। জগৎ সিং বা জাগ্গু যে এলাকাটির ভয়কর লোক হিসেবে পরিচিত তার প্রেম এক ইমামের মেয়ে নুরানের সাথে। ডাকাতরা যাওয়ার সময় তার বাড়িতে ডাকাতির একটি ভাগ ফেলে যায়। তার প্রেমিকা তাদের একজনকে দেখেও ফেলে, জানা যায় তার নাম মালি। পরদিন ম্যাজিস্ট্রেট এসে পৌঁছায়। সে খোঁজ খবর করে ধর্মীয় কোনো দাঙ্গা হয়েছে কীনা। একসময় সে সাব ইন্সপেক্টরকে একজন পতিতার ব্যবস্থা করে দিতে বলে।

একদিন গ্রামটির ভয় ও অস্থিরতার সব সীমা অতিক্রম করে যায় যখন শিখদের লাশভর্তি একটি ট্রেন এসে পৌঁছায় রেল স্টেশনে। মানো মাজরার মানুষের পারস্পরিক সহাবস্থান নষ্ট হয়ে যায়, শিখ-মুসলিম-হিন্দুদের পরস্পরের মধ্যে জন্ম নেয় বিদ্বেষ, ভয়। গ্রামবাসীদের ধারণা, পরের ট্রেনটি আসবে মুসলমানদের লাশ নিয়ে। জগৎ সিং অস্থিরচিত্ত আর উৎকণ্ঠায় ভাবে তার প্রেমিকাও ওই ট্রেনে থাকবে, কারণ সে তো মুসলমান।

প্রেম, ধর্ম, সম্পর্ক, দেশভাগের নিষ্ঠুরতা, জন্মস্থান হারানোর বেদনা, মানুষের চিরায়ত দ্বিধা ও ভালোবাসা আর ভূরাজনীতির প্রভাবে সবকিছুই ধ্বংসের মুখে পড়ে যাওয়া এক গ্রাম মানো মাজরা। যে গ্রাম আমাদের খুব চেনা এখনও, যেহেতু এখনও দেশে দেশে গ্রামটির শান্তি সাক্ষাৎ দোজখে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। খুশবন্ত সিং আমাদের সেই গল্পই বলেন, জটিল-কুটিল, সহজ-সাধারণ অজস্র চরিত্রের মাধ্যমে।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মাকোন্দো গ্রামের জাদুবাস্তবতার নিদর্শন যেন লাশ ভর্তি হয়ে আসা ট্রেন। মার্কেজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার সব গল্পই বাস্তব। এর প্রমাণ পাওয়া যায় খুশবন্ত সিং-এর এই উপন্যাসে, যে বাস্তবও কেমন জাদুবাস্তব হয়ে উঠতে পারে।

জাগ্গুর হৃদয়ে নুরানকে হারানো ভয় যেন সেই চিরকালীন মানুষেরই গল্প, যারা সমাজ-রাষ্ট্রের লোভের কাছে অসহায় হয়ে যায়। তাই এই উপন্যাসটি মানুষের সুখ-দু:খে একান্ত ছবি হয়ে ওঠে। “ট্রেন টু পাকিস্তান” হয়ে ওঠে দূষিত সমাজের এক রূপক।

ট্রেন টু পাকিস্তান
লেখক : খুশবন্ত সিং
অনুবাদক : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
বিষয় : অনুবাদ উপন্যাস
প্রকাশক : ঐতিহ্য
প্রকাশকাল : ২০২৫
মূল্য : ৩৯০ টাকা।

বইটি কিনতে চাইলে:

ট্রেন টু পাকিস্তান (Train To Pakistan) – বাহিরানা

 

(Visited 4 times, 1 visits today)

Leave a Comment