দিপু চন্দ্র দেব
“বেলা আন্দাজ করতে পাশের আলিশান বটগাছটার ঘাড়ে-গর্দানে চোখ তুলতেই শরীরে আচমকা হিম হাওয়ার তাণ্ডব। নাড়ার মতো খরখরে আঙুলে কোদালের হাতলটা জাপটে ধরে আদম আলী। নুয়ে আসা ডালে ঝুলছে মানুষের জ্যান্ত জোড়া খণ্ডিত পা! কর্তাবাবুর ধবধবে পা নাকি? চোখ রগড়ায় সে। আরে, কোথায় কর্তাবাবুর ধবধবে পা! ঐ তো একজোড়া গুচ্ছমূলে রোদের ঝিলিক! লম্বা দম।” (অজগর)
এভাবেই হরিপদ দত্তের “অজগর” উপন্যাসের সূচনাবাক্যগুলো গড়ে উঠেছে। প্রথম পাঠেই এর শিল্পকুশলতার দিকে দৃষ্টি পড়তে পড়তেই “আলিশান বটগাছ” “কর্তাবাবু” “ধবধবে পা” শব্দগুচ্ছ তাদের অর্থের দিকে টেনে নেয়। সহজেই ধরা পড়ে সামন্তযুগের কোনো জমিদারের পায়ের কথা বলা হচ্ছে, যার ধবধবে পাজোড়া আর তাকে “কর্তাবাবু” সম্বোধন করা আদতে তিনি যে দেশীয় ইংরেজ মানে তাদের প্রতিনিধি আর কর্তাবাবু যে সাহেবেরই দেশীয় প্রতিনিধির সম্বোধন তা-ই ধরা পড়ে। তিনি তার মুসলমান প্রজাদের “নেড়ে” বলেন, তাদেরকে তার সাথে কথা বলার সময় চোখ নামিয়ে রাখতে হয়। পুরো উপন্যাসের গল্পটিই শুরুর এই কয়েকটি বাক্যে পেয়ে যাই আমরা।
দমন-পীড়ন, গুমের যে পরিবেশ আমরা দেখেছি এই দেশে তা একদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে আছে শ্রেণীদ্বন্দ্ব। বিজয়ী শ্রেণী বিজিতকে মুছে দিতে চেয়েছে, তার পরিচয় বিকৃত করতে চেয়েছে। আমাদের একটি দীর্ঘ ঔপনিবেশিক সময়পর্ব ছিল, তখন যে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা তৈরি করা হতো—তার সবই শাসকের প্রয়োজনে। এর আগে এরকম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কখনও ছিল না, তবে বিভেদ তৈরির পর সেটার দাগ রয়ে গেছে। অজগর তৈরি হয়ে গেছে, এর থেকে মুক্তি প্রয়োজন।
ইংরেজ আমল থেকে বাংলাদেশ ও তৎপরবর্তী অবস্থা সবকিছুই উঠে এসেছে “অজগর”-এ। এখানে অজগর একটি রূপক। যার মাধ্যমে ধর্মের রাজনীতি, দুর্ভিক্ষ, হানাহানি, সামন্তদের অত্যাচার ফুটে উঠেছে। অজগর তার শিকারকে শ্বাসরোধ করে মারে, একবার তার কবলে পড়লে বেঁচে ফেরা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশ বহুকাল যাবতই বাঁচার চেষ্টা করছে, তারও নজির তুলে ধরেছেন হরিপদ দত্ত।
উপন্যাসটি আমাদের জাতীয় মানসে যে ক্ষত আছে তাকে দেখতে চেয়েছে, এর কারণটাও বের করতে চেয়েছে। দমন-পীড়ন, গুমের যে পরিবেশ আমরা দেখেছি এই দেশে তা একদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে আছে শ্রেণীদ্বন্দ্ব। বিজয়ী শ্রেণী বিজিতকে মুছে দিতে চেয়েছে, তার পরিচয় বিকৃত করতে চেয়েছে। আমাদের একটি দীর্ঘ ঔপনিবেশিক সময়পর্ব ছিল, তখন যে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা তৈরি করা হতো—তার সবই শাসকের প্রয়োজনে। এর আগে এরকম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কখনও ছিল না, তবে বিভেদ তৈরির পর সেটার দাগ রয়ে গেছে। অজগর তৈরি হয়ে গেছে, এর থেকে মুক্তি প্রয়োজন। কিভাবে একে সমূলে উৎখাত করা যায় তার দায় পুরো দেশের হাতেই।
বাংলাদেশকে হাড়ে মজ্জায় জানতে “অজগর” উপন্যাসটি পড়ার বিকল্প নেই। এ গেলো একটি কারণ, কিন্তু এর শিল্প আবেদনের কথা না বললে অনেক কথাই বাকি থেকে যায়, হরিপদ দত্ত তার নির্মাণ কৌশলে অনবদ্য এক শিল্পসুষমার জগৎ এঁকেছেন “অজগর”-এ। বইযের কয়েকটি বাক্য দিয়ে লেখা শেষ করি,
“কর্তাবাবুর গর্জন জানালার ফাঁকে ধূপের ধোঁয়ার সাথে বেরিয়ে এসে ঢুকে যায় আদম আলীর কানে। আদম আলী দাঁড়িয়ে থাকে যেন মরাগাছ। তার মনে ভয়ের প্রতিক্রিয়া নেই। সে কি কর্তাবাবুর জন্য উপহার আনেনি! সে জানে ঠিকই কর্তাবাবু বদরাগী খেপাটে গোছের মানুষ। মুসলমান প্রজাদে তিনি নেড়ে বলেই সম্বোধন করেন।”
ইংরেজরা ভারতীয়দের অর্ধমানুষ ভাবত, তাদেরই এক দেশীয় প্রতিনিধির মধ্যেও কী অবলীলায় গুণটি ঢুকে পড়েছিল, আর কী অসাধারণভাবে লেখক সেটিকে তুলে এনেছেন, তা পাঠান্তে বিস্মিতই করে।
অজগর
লেখক : হরিপদ দত্ত
বিষয় : উপন্যাস
প্রকাশকাল : ২০২৫
প্রকাশক : প্রসিদ্ধ পাবলিশার্স
দাম : ৮০০ টাকা।
বইটি কিনতে চাইলে: