বাহিরানা

কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল বই রিভিউ: যে বই প্রকাশের আগে-পরে মানুষ একইরকম থাকেনি


শাশ্বত বই রিভিউ

পৃথিবীতে দর্শন, অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্রের বিশ্লেষণে যত বই প্রকাশিত হয়েছে কার্ল মার্ক্সের “ডাস ক্যাপিটাল” বা পুঁজি বইটি তার মধ্যে অন্যতম ও বিশেষ। ডাস ক্যাপিটাল প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৭ সালে কার্ল মার্ক্সের জীবিত কালে। তার মৃত্যুর পর এর দ্বীতিয় ও তৃতীয় খণ্ড যথাক্রমে ১৮৮৫ ও ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত হয় বন্ধু, সহযাত্রী ও সহকর্মী ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের সম্পাদনায়। প্রকাশের পর থেকে এখন পর্যন্ত বইটি প্রতি কালেই নতুন নতুন চিন্তকদের, সমাজ ও রাষ্ট্র বদলে আগ্রহীদের এবং সাহিত্যিকদের প্রেরণা ও নতুন ভাষ্য নির্মাণে রসদ যুগিয়ে যাচ্ছে। বলা ভালো, বইটি প্রকাশের আগে ও পরে মানুষের জ্ঞান আর একইরকম থাকেনি।

একদিন শ্রমিকরা ক্ষমতাযন্ত্রের দখল নিয়ে নিজেদের আধিপত্য তৈরি করবে। তখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে কিছু থাকবে না, সম্পতি সবই হবে রাষ্ট্রের। এবং কোনো শ্রেণীই থাকবে না। সাম্যের মূল কথাটাই এই যে সেটা হবে শ্রেণীহীন। এরকম শ্রেণীহীন সমাজের উদাহরণ আমরা দেখতে পাই সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯১৭ সালে, লেলিনের নেতৃত্বে হওয়া বলশেভিক বিপ্লব বা অক্টোবর বিপ্লবে। তবে সেটা টিকেনি, ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আমরা দেখেছি। কিন্তু শ্রেণীহীন সাম্যের সমাজের স্বপ্ন মরেনি।

আধুনিক ‍যুগকে পুঁজিবাদী যুগ বলা হয়। মানব সভ্যতা ইতিহাসের এই পর্যন্ত আসতে আদীম সাম্যবাদ, দাস ব্যবস্থার যুগ, সামন্তবাদ পাড়ি দিয়ে পুঁজিবাদী স্তরে উপনীত হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদ বললেও পুঁজির চরিত্র আসলে কীরকম? সেটি কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল বইটি প্রকাশের আগে কেউ ধরতে পারেনি। তিনিই প্রথম এর গঠন, প্রবণতা ও আত্মধ্বংসী রূপ ব্যাখ্যা করেছেন তিন খণ্ডের এই বইয়ে।

ডাস ক্যাপিটালের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে শ্রমের উদ্বৃত্ত তত্ত্ব। একটি পণ্য উৎপাদনের জন্য শ্রম প্রয়োজন হয়, শ্রমের মাধ্যমে কিছু বিচ্ছিন্ন উপাদান একটি পণ্য হয়ে ওঠে এবং এর ফলে সেটি বিক্রয়যোগ্য হয়ে মুনাফা তৈরি করে। শুনতে অদ্ভুত শোনালেও, সেই মুনাফার সিংহভাগই যে শ্রমিকেরা শ্রম দিয়েছে তাদের কাছে না পৌঁছে পণ্যের মালিক মানে পুঁজিপতির কাছে চলে যায়। এই ফাঁকিটাই মোটা দাগে পুঁজিবাদ। এই ফাঁকি থেকে অর্থ ও সম্পদের একটা ব্যবধান তৈরি হয় আর তার ফলেই উৎপত্তি হয় ধনীকশ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণীর। তাই পুঁজিবাদী সমাজে মূল শ্রেণী হচ্ছে দুইটি, এক, শ্রমিক শ্রেণী যাদের শ্রমে পণ্য উৎপাদিত হয়, দুই, মালিক শ্রেণী, যারা অর্থ বিনিয়োগ করে মুনাফার বড় অংশ শ্রমিকদের বঞ্চিত করে নিজেরা কুক্ষিগত করে পুঁজিপতি হয়।

ডাস ক্যাপিটালের সহায়ক গ্রন্থের একটি মাইকেল ওয়েইনের কার্ল মার্ক্স-এর ডাস ক্যাপিটাল: পাঠ প্রবেশিকা বইটির রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে বাহিরানায়, পড়তে পারেন:

মাইকেল ওয়েইনের কার্ল মার্ক্স-এর ডাস ক্যাপিটাল: পাঠ প্রবেশিকা রিভিউ

পুঁজি প্রথম খণ্ডের অনেকাংশজুড়েই সাম্রাজ্যবাদ, উৎপাদন প্রক্রিয়া ও শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন কার্ল মার্ক্স। ব্রিটেনের শ্রমিকদের প্রতি কারখানা মালিকদের কৃত অন্যায্যতার বিষয়টিও এসেছে তার আলোচনায়। দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম অংশের মূল আলোচ্য বিষয় পুঁজির পরিভ্রমণ বা চক্রায়ন। পুঁজি কীভাবে ঘূর্ণনের মাধ্যমে শ্রমিকশক্তি, উৎপাদন ও বিক্রিত দ্রব্যের চক্রে নিজেকে পুনরুৎপাদন করে—তাতে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। দ্বীতীয় অংশের আলোচ্য বিষয়, পুঁজির টার্নওভার নিয়ে, উৎপাদন থেকে বিক্রয় পর্যন্ত যে সময় ব্যয় হয় সেটিকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে পুঁজির উৎপাদন প্রক্রিয়ার সামগ্রিক একটা চিত্র তৈরি করা। এই খণ্ড সাতভাগে সমাপ্ত হয়েছে।

পুঁজির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি আত্মধ্বংসী, কারণ এটা অনেকটাই দাস ব্যবস্থার মতো। পুঁজি সর্বগ্রাসীও, শ্রমীকশ্রেণী ছাড়া সে আবার নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পারে না। আর তার প্রাণভোমরা শ্রমিকশ্রেণী যখনই মুনাফা বিতরণের অন্যায্য পদ্ধতি বিষয়ে সচেতন হয় তখনই তারা বিদ্রোহ করে। সেই দ্রোহ চলমান এখনও।

সাম্যবাদ বা কম্যুনিজম বলতে আমরা যা বুঝি সেটা যদি এভাবে দেখা যায়, কোনো কোম্পানীর মুনাফা সবার ভাগেই সমানভাগে পড়ছে তাহলে সেখানে কোনো ধনীক শ্রেণী তৈরি হতে পারে কী? পারবে না কারণ তখন সকলেই মালিক। একদিন এরকমই ঘটবে বলে ধারণা মার্ক্সের। একদিন শ্রমিকরা ক্ষমতাযন্ত্রের দখল নিয়ে নিজেদের আধিপত্য তৈরি করবে। তখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে কিছু থাকবে না, সম্পতি সবই হবে রাষ্ট্রের। এবং কোনো শ্রেণীই থাকবে না। সাম্যের মূল কথাটাই এই যে সেটা হবে শ্রেণীহীন। এরকম শ্রেণীহীন সমাজের উদাহরণ আমরা দেখতে পাই সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯১৭ সালে, লেলিনের নেতৃত্বে হওয়া বলশেভিক বিপ্লব বা অক্টোবর বিপ্লবে। তবে সেটা টিকেনি, ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আমরা দেখেছি। কিন্তু শ্রেণীহীন সাম্যের সমাজের স্বপ্ন মরেনি।

বর্তমানে পুঁজির বিশ্বায়ন ঘটেছে প্রবলভাবে। পণ্যের বাইরে কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না। আর এর থেকে উত্তরণের জন্য মার্ক্সের দেখানো পথের বিকল্পও আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। তাই বইটি এখনও এতো প্রাসঙ্গিক যে, বারেবারেই আমাদের কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল-এর কাছে ফিরতে হয়।

ডাস ক্যাপিটাল
লেখক: কার্ল মার্ক্স
প্রকাশকাল: প্রথম খণ্ড -১৮৬৭
দ্বিতীয় খণ্ড – ১৮৮৫
তৃতীয় খণ্ড – ১৮৯৪


মন্তব্য করুন