২০২৪-এর জুলাই শেষ হয়েছিল আগস্টে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল ক্ষমতার পট পরিবর্তনে এক অভূতপূর্ব জনস্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও সংযুক্তির ঘটনা বাংলাদেশের জন্য। গভীরভাবে দেখলে অসংখ্য ঘটনারাশি সেখানে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে ছিল, যা সাধারণ চোখে দেখা যায় না। অসংখ্য মানুষের ক্ষোভ, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের দীর্ঘ অধ্যায়, বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি অবদমনমূলক পন্থা বেছে নেওয়া—এসবই সেখানে যুক্ত হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তশ্রেণীর সংযুক্তি—৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর কোনো গণ-আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণী এভাবে এত বিশালভাবে অংশগ্রহণ করেনি—ক্ষমতার পালাবদলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে, কারণ তাদের কারণেই আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো বাংলাদেশে বিষয়ে সর্তক হয়ে পড়ে (ইতিবাচক অর্থে)। লেখক, গবেষক আলতাফ পারভেজের লাল জুলাই: চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমা এই জুলাইয়ের ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ নিয়ে। ২০২৫-্এই প্রকাশিত নজরুল ইসলামের লাল বসন্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দিনলিপি বইটিতেও জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-এর ঘটনাবলির ধারাবাহিক লিপিবদ্ধকরণ পাই আমরা। তিনি ২০১৮-এর কোটাবিরোধী আন্দোলনের ফসল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানকে।
এখানে বলে রাখা উচিত, আলতাফ পারভেজ “আন্তনিও গ্রামসি ও তার রাষ্ট্রচিন্তা” অনুবাদ করেছেন। মার্ক্সয়ীয় তত্ত্ব জগতে গ্রামসি যেসব কারণে বিখ্যাত তার মধ্যে তার “হেজিমনি তত্ত্ব” রয়েছে। সংক্ষেপে ক্ষমতাসীন দলের বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যই তত্ত্বটির সারকথা। তাই এই বইটিতে আলতাফ পারভেজের জুলাইয়ের সাথে সংস্কৃতির যুক্ততার বিষয়ে আলোচনা বিশেষ পাঠযোগ্যতা দাবী করে।
আলতাফ পারভেজ ক্ষমতা তত্ত্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ে ভালো বোঝেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর উপর তার গুরুত্বপূর্ণ বই আছে। তাই জুলাইয়ের ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ বিশেষভাবে গুরুত্ব রাখে। বইটিতে গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমি থেকে এর সংগঠকদের তখনকার বর্তমান ও আগের কর্মকাণ্ডে বিরবণ দিয়েছেন তিনি, তার বিশ্লেষণসহ। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও এসেছে।
২০২৪ সালের জুলাইকে অনুধাবন করতে কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। তা হলো, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়টি দেখলে আমরা দেখতে পাই ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছেড়ে যাওয়ার আগে ১৯৪৭ সালে দুইটি দেশের জন্ম দিয়েছিল ভারতকে ভেঙে, দেশগুলো হলো ভারত ও পাকিস্তান। তখন পূর্ব বাংলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেয় নিজেদের উন্নতির স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন ও আশায় ভাঙন ধরে ক্রমে, এরপর ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন ও তারই পথপরিক্রমায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু লাখো-লাখো শহীদের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল তা কী রক্ষা করা গেছে ঠিক মতন? স্বাধীনতার মূলে যে গণতন্ত্র বাংলাদেশে তারই ভিত ধ্বসে গেছে কয়েকবার, স্বৈরশাসনের যাতাকলে। এরমধ্যে এরশাদের স্বৈরশাসন উচ্ছেদে হয়েছিল নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান, কিন্তু অস্বাধীনতা যেন বেঁধে রেখেছিল এই জাতিকে, কারণ তারপর সবকিছু গণতান্ত্রিকভাবে চললেও ২০০৭ এর নির্বাচনের পর থেকে সব পাল্টে যেতে শুরু করল আবার। যারা ক্ষমতায় এলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রশ্নে তাদের কাছে জনগণের মূ্ল্য ক্রমেই কমে যেতে শুরু করল, একসময় দাঁড়াল এমন যে, স্বাধীন চিন্তক ও জনগণই হয়ে গেলো ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার একমাত্র বাধা। কেন? কারণটা খুবই সহজ, তা হলো গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো নির্বাচন আর সেই নির্বাচনে ভোট লাগে, দেশের নাগরিকগণই দেয় সেই ভোট। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে সেই ভোটই উঠে গেলো, আর ভোটের প্রয়োজন নেই। তাহলে যারা দেশ চালাচ্ছে তাদের নির্বাচিত করছিল কারা? কারা দিয়েছিল ভোট? ভোটগুলো ভূতেরা দিয়েছে রাতের বেলা। এসব খবর বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ থেকে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো—সবাই জানত। কিন্তু দেশের জনগণ যারা এই গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, তাদেরকে ঢোকানো হচ্ছিল আয়নাঘরে। আয়নাঘরে নেওয়া মানুষগুলো কে কোথায় ছিল বা আয়নাঘরই বা কোথায় অবস্থিত, তা তাদের পরিবার ও দেশবাসী, কেউই জানত না। গুমখুনের এ এক অভিনব নিদর্শন চলছিল বাংলাদেশে বছরের পর বছর, সংখ্যার হিসেবে ১৫ বছর ধরে।
বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের একটি প্রধান শর্ত মানবিক উন্নয়ন ও বাকস্বাধীনতা, কিন্তু বাংলাদেশে তখন চলছিল লোক দেখানো স্থাপনাগত উন্নয়ন। বাকস্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে কাঠামোগত উন্নয়নের ফল হয়েছিল শূন্য। কারণ রোবট নয় মানুষই উন্নয়নের একমাত্র ফলভোগী হওয়ার কথা, আর সেই মানুষকেই যদি ধ্বংস করে দেওয়া হয় তাহলে সেই উন্নয়নের মূল্য বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। বাংলাদেশে তাই হয়েছিল।
কিন্তু ২০২৪-এর জুলাইয়ে জনতার ক্ষোভের বাধ ভেঙে যায়, কোটাবিরোধী আন্দোলন আবু সাঈদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রূপ নেয় বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের সর্ববৃহৎ গণঅভ্যুত্থানে। অবৈধ ক্ষমতার ভাগীদের পরিবারসুদ্ধ দেশত্যাগ করতে হয় সেই উন্মত্ত স্বাধীনতাকাঙক্ষায় জেগে ওঠা জনতার রোষে। কিন্তু ২০২৪-এর জুলাই কী ইতিহাসবিচ্যুত কোনো ঘটনা? এটা কী অকস্মাৎ আবির্ভূত হয়ে অবৈধ ক্ষমতার মেরুদণ্ড সমূলে উৎপাটন করেছে? আলতাফ পারভেজের লাল জুলাই: চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমা বইটিতে তিনি অবিস্মরণীয় মাসটির ঘটনাগুলো উল্লেখের সঙ্গে পেছনের ইতিহাসও ভুলেন না। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো কিছুই অকস্মাৎ ঘটে না, যেকোনো ঘটনার পেছনে থাকে দীর্ঘ ইতিহাস, জুলাইয়েও ছিল। তা হলো ক্ষমতাসীনদের দ্বারা বিরোধীদলগুলোকে নিপীড়ন, বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ মধ্যবিত্ত ও ক্ষুধায় কাতর নিম্নবিত্তদের দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস আর বেশুমার রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ। লেখার স্বাধীনতা রদসহ আরো অজস্র অবদমন সারা বাংলাদেশকেই একযোগে জাগিয়ে দিয়েছিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো। ফলে ছাত্রজনতার সঙ্গে জনগণ, কবি, সাহিত্যিক, র্যাপ সংগীতশিল্পী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, অবিভাবকসহ সবাই একজোট হয়ে গিয়েছিল, মৃত্যু ভুলে। প্রায় দু্ই হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে এই গণঅভ্যুত্থানে। এত স্বল্প সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো সরকার এত মানুষ মারেনি যা জুলাইয়ে দেখা গেছে বাংলাদেশে। আলতাফ পারভেজের লাল জুলাই বইটিতে সেই সময়টি তার অবদমনের, গুমখুনের ইতিহাসসহ বাস্তব হয়ে উঠে ধরা দেয় আমাদের চোখে। বইয়ের নামই ধারণা দেয় কী হয়েছিল মাসটিতে, লালরঙ তো রক্তের।
এখানে বলে রাখা উচিত, আলতাফ পারভেজ আন্তোনিও গ্রামসি ও তার রাষ্ট্রচিন্তা অনুবাদ করেছেন। মার্ক্সয়ীয় তত্ত্ব জগতে গ্রামসি যেসব কারণে বিখ্যাত তার মধ্যে তার “হেজিমনি তত্ত্ব” রয়েছে। সংক্ষেপে ক্ষমতাসীন দলের বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যই তত্ত্বটির সারকথা। তাই আলতাফ পারভেজের লাল জুলাই চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমা বইটিতে জুলাইয়ের সাথে সংস্কৃতির যুক্ততার বিষয়ে আলোচনা বিশেষ পাঠযোগ্যতা দাবী করে। বিগত সরকারের সাংস্কৃতিক বলয়—যেটা বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যেরই অংশ—ভেঙে পড়েছিল তখন এমনই প্রতীতি জন্মায়।
পূর্বেই বলা হয়েছে জুলাইয়ের অনেকগুলো অংশ ছিল, তাই একপাক্ষিক আলোচনা সম্ভব নয়, কারণ প্রায় সব রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ, মধ্যবিত্ত শ্রেণী যুক্ত হয়েছিল সেখানে। এই জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবনে আলতাফ পারভেজের লাল জুলাই চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমা বইটি বিশেষ সহায়ক হবে।
লাল জুলাই: চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমা
লেখক: আলতাফ পারভেজ
বিষয়: রাজনীতি, ইতিহাস
প্রকাশকাল: ২০২৫
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
মূল্য: ৫৫০ টাকা।
লাল জুলাই: চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমা বইটি কিনতে চাইলে