বাহিরানা

আনিসুজ্জামানের পূর্বগামী: কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন


লেখক, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পূর্বগামী প্রবন্ধগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ সালে, তবে সীমিত সংখ্যক মুদ্রণের জন্য প্রায় অপরিচিতিই রয়ে গেছে পাঠকমহলে। আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের মননশীলতা চর্চার প্রতীক ছিলেন একসময়। তিনি তার সময়ের অন্য গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক, মননশীল লেখদের নিয়েও উদাসীন ছিলেন না। তিনি এমনকি সরদার ফজলুল করিমের সরদার ফজলুল করিম: দিনলিপি বইয়ের ভূমিকাও লিখেছিলেন। সমসাময়িক বিষয় এবং লেখদের পঠনপাঠন,  প্রশংসা ও সমালোচনার ক্ষেত্রে এক উচ্চ ভূমি আবিষ্কার করেছিলেন তিনি নিজের মধ্যে। যা তিনি দৈহিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন। এই গুণটি তার দৃষ্টিকে ব্যক্তিগত ঈর্ষা মুক্ত করে দিয়েছিল স্বচ্ছতা ও গভীরভাবে দেখার শক্তি। আর এই মননশীলতার চর্চায় তার আদর্শ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আনিসুজ্জামানের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণায় ১৯৩৭ সালের ব্রিটিশ ভারতে। তার গবেষণা ও প্রবন্ধগ্রন্থ অসংখ্য, সে সংখ্যায় এখানে না যাওয়াই ভালো, তবে বলা যায় তার লেখা স্বমহিমায় উজ্জ্বলতা ধরে আছে। পূর্বগামী বইটির বর্তমান সংস্করণ কথাপ্রকাশ করেছে।

“বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস প্রসঙ্গে” ও “নজরুল ইসলাম ও তার কবিতা” প্রবন্ধ দু’টি আমাদের সময়ে বিশেষ মনোযোগের দাবী রাখে। কারণ, নজরুলের কবিতাবিচার এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, অনেক বিবেচনাই এখনও বাকি।

আনিসুজ্জামানের পূর্বগামী বইয়ে প্রবন্ধ রয়েছে ২৮ টি। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে কবি শামসুর রাহমান, চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরসহ অসংখ্য লেখক, সাহিত্যিকের উপর প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে বইটিতে। বইয়ের নাম থেকেই অনুমান করা যায় এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে, পূর্বগামী মানে যারা পূর্বে এসেছিলেন, গমন করেছিলেন। ফলে, আনিসুজ্জামানের পূর্বগামী বইটিতে থাকা সব প্রবন্ধই তার পূর্বজদের নিয়ে।

পাঠকালে একটি বিষয় দৃষ্টি এড়ায় না, যে, ২৮টি প্রবন্ধের সিংহভাগই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। এগুলোকে আলাদা করে আরেকটি বই-ই করে ফেলা সম্ভব ছিল। রবীন্দ্রনাথের ভানুসিংহের পদাবলী থেকে তার ধর্ম, সংগীত, সমাজচিন্তা, ভিনদেশে তার লাগানো গাছ দেখার স্মৃতি—কী নেই।

অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে তো আর কয়েকটি প্রবন্ধে ধরা সম্ভব নয়, তবে বইটির প্রবন্ধসংখ্যার বিবেচনায় এটি অনেক বেশি। কয়েকটি স্মরণলেখা ও শ্রদ্ধার্ঘও রয়েছে, যা উক্ত লেখকদের নিয়ে আমাদের কাছে আনিসুজ্জামানের স্মৃতির চূর্ণ ও মূল্যায়ন পৌঁছে দেয়। যেমন, “শওকত ওসমান”, “সুফিয়া কামাল (শ্রদ্ধার্ঘ)”, “আহমদ শরীফ স্মরণে”, “আবুল ফজল: স্মৃতিকথা”।

লেখকদের আক্রমণের জন্য শনিবারের চিঠি শুধু জীবননান্দ দাশকেই বেছে নেয়নি, নজরুল ইসলামকেও আক্রমণের বিষয়বস্তু করেছিল, তাও জীবননান্দের চেয়ে বেশিই বলা যায়। এ নিয়ে বইটিতে “কবির প্রতি শনির দৃষ্টি” নামে একটি লেখা রয়েছে, যা খুবই আগ্রহোদ্দীপক।

“বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস প্রসঙ্গে” ও “নজরুল ইসলাম ও তার কবিতা” প্রবন্ধ দু’টি বর্তমান সময়ে বিশেষ মনোযোগের দাবী রাখে। কারণ, নজরুলের কবিতাবিচার এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, অনেক বিবেচনাই এখনও বাকি। একটি বিষয় ঘুরেফিরে আসে, নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দিনকে কেন বুদ্ধদেব বসু তার আধুনিক কবিতার সংকলনে স্থান দিলেন না? এতে কী পঞ্চপাণ্ডবদের চেয়ে নজরুলের গুরুত্ব কমে যায়। মোটেও তা নয়, তবে বুদ্ধদেব বসু ইউরোপবাহিত আধুনিকতার যে সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছিলেন সেখানে নজরুল ইসলামের কবিতা বদ্ধ হয় না। এতে পঞ্চপাণ্ডব ও নজরুল কারুরই গুরুত্বচ্যুতি হয় না। আনিসুজ্জামানকৃত নজরুল ইসলামের কবিতার মূল্যায়ন তার কবিতার নতুন নতুন ধারা-উপধারা আবিষ্কারে সহায়ক ভূমিকা নেবে। তাই এটি গুরুত্বপূর্ণ।

বইটি যারা সাহিত্য ও চিন্তায় আগ্রহী ও আনিসুজ্জামানের লেখা পছন্দ করেন তাদের সবাইকেই আনন্দ দেবে।

পূর্বগামী
লেখক: আনিসুজ্জামান
বিষয়: প্রবন্ধ
প্রকাশকাল: ২০২৫
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ
দাম: ৪৫০ টাকা। 

 


মন্তব্য করুন