দিপু চন্দ্র দেব
মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো তার শৈশব। কারণ এই সময়ের অভিজ্ঞতাই তার পরবর্তী জীবনের চালিকা শক্তি হয়। তার আত্মবিশ্বাস, কৌতূহল, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিষ্টাচার—সবই এই বয়সে গঠিত হয়। এক্ষেত্রে পরিবার আর বিদ্যালয় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে, আরেকটি বিষয়ও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো বই। কারণ বইয়ের মধ্যে যে গল্প থাকে, চিত্র থাকে সেগুলো তার মধ্যে অভিজ্ঞতার সঞ্চার করে, বৃহৎ ও মহত্বের এক জীবনের কথা বলে তাকে। কিন্তু তার জন্য বইও সৃষ্টিশীল হওয়া চাই, যা তার জানার, বোঝার পরিধি বৃদ্ধি করবে। এরকম শিশুসাহিত্যের সংখ্যা কম, বিশেষ করে বাংলাদেশে। তবে আশার কথা এই, চিরায়ত কিছু বই রয়েছে, যাদের আবেদন ফুরোবার নয়। যেমন বাংলায় সুকুমার রায়ের “আবোল তাবোল” দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের “ঠাকুরমার ঝুলি” রবীন্দ্রনাথেরও অনেক শিশু-কিশোর উপযোগী লেখা রয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বসাহিত্যের কথা বললে অনুবাদের কথাটিও এসে যায়, যিনি অনুবাদ করছেন তিনি শিশুদের মনস্তত্ত্ব বোঝেন তো?। বাংলা ভাষায় উল্লেখযোগ্য অনুবাদকদের মধ্যে ননী ভৌমিক সম্ভ্রান্ত নাম। তিনি অজস্র চিরায়ত রুশসাহিত্য অনুবাদ করেছেন, যেগুলো আজও পঠিত হয়। ননী ভৌমিকের অনুবাদে লেভ তলস্তয়ের “শিশু কাহিনী” সেরকমই একটি বই।
“বেড়ালছানা” গল্পে আমরা দেখতে পাই ভাসিয়া আর কাতিয়া দুই ভাই-বোন, তাদের আবার একটি বেড়াল আছে। একদিন সেই বেড়াল পাঁচটা বাচ্চার জন্ম দেয়, বেড়ালছানা পেয়ে ভাইবোন দু’জনের খুশির অন্ত নেই। এর মধ্যে “ছেয়ে রঙের” একটি বাচ্চাকে তাদের মা বাড়িতে নিয়ে আসার অনুমতি দিলেন, বাকিগুলোকে বিলিয়ে দিলেন। কিন্তু ঘটনা বদলে যায় একদিন তারা যখন বেড়ালছানাটিকে নিয়ে মাঠে বেড়াতে যায় তখন, বেড়ালছানাটি এক শিকারীর কুকুরের কবলে পড়ে।
লেভ তলস্তয় যে শুধুমাত্র বড়দের “ওয়ার এন্ড পিস” “আনা কারেনিনা”-ই লিখেছেন তা নয়। তিনি অনেক নৈতিকতার গল্পও লিখেছেন, যেমন, “তিনটি প্রশ্ন” “কতটুকু জমির প্রয়োজন”। এই নীতিগুল্পগুলো আজও আমাদের ভোগবাদী সমাজ নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। সেইসাথে তিনি ছোটদের জন্যেও লিখেছেন। তার অন্যসব বিখ্যাত কাজের মতোই জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি পেয়েছে এই গল্পগুলো। এগুলো তিনি লিখতে শুরু করেন তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ “ওয়ার এন্ড পিস” লেখার পরেই, আনা কারেনিনা লেখার সময়েও তিনি এই লেখাগুলো থামাননি। অমূল্য সাহিত্যকর্মগুলো তিনি রচনা করেছিলেন তিনিখণ্ডে। যা আজও হীরকখণ্ড হয়ে জ্বল-জ্বল করছে। সেগুলো থেকে বাছাই করা গল্প অনুবাদ করেছেন ননী ভৌমিক।
বইয়ে গল্প আছে তেরোটি। প্রতিটিই জীবনের ভিন্ন-ভিন্ন দিকের কথা বলে। যেমন “বেড়ালছানা” গল্পে আমরা দেখতে পাই ভাসিয়া আর কাতিয়া দুই ভাই-বোন, তাদের আবার একটি বেড়াল আছে। একদিন সেই বেড়াল পাঁচটা বাচ্চার জন্ম দেয়, বেড়ালছানা পেয়ে ভাইবোন দু’জনের খুশির অন্ত নেই। এর মধ্যে “ছেয়ে রঙের” একটি বাচ্চাকে তাদের মা বাড়িতে নিয়ে আসার অনুমতি দিলেন, বাকিগুলোকে বিলিয়ে দিলেন। কিন্তু ঘটনা বদলে যায় একদিন তারা যখন বেড়ালছানাটিকে নিয়ে মাঠে বেড়াতে যায় তখন, বেড়ালছানাটি এক শিকারীর কুকুরের কবলে পড়ে। তখন আমরা দেখতে পাই ছোট্ট ভাসিয়ার মমত্ব ও সাহসিকতা।
“বেড়ালাছানাটাকে ছোঁ মারতে চেয়েছিল কুকুরদুটো, কিন্তু ভাসিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ে বুক দিয়ে আড়াল করে রাখল তাকে।”
(বেড়ালছানা)
এই গল্পে প্রাণীর জন্য দরদের পাশাপাশি মানুষ ও প্রাণীজগতের সহাবস্থানের শিক্ষাও আছে। মানুষ চাইলে পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, আগল রাখতে পারে তাকে ভাসিয়ার মতো।
প্রতিটি গল্পই এরকম শিক্ষামূলক, যা শিশুদের জগতের মর্ম শেখাবে। যেমন আরেকটি অসাধারণ গল্প, খাঁচা ছেড়ে পালাতে গিয়ে জানালার শার্শিতে মরণ আঘাত পাওয়া পাখির কাহিনী। গল্পটি থেকে কয়েকটি বাক্য তুলে দিলাম এখানে,
“সারাদিন খাঁচা ছেড়ে নড়ল না সেরিওজা, কেবলি চেয়ে রইল পাখিটার দিকে, পাখি কিন্তু মুখ থুবড়ে ওভাবেই শুয়ে রইল, নিঃশ্বাস পড়ছিল ঘন ঘন। সেরিওজা যখন ঘুমতে গেল, পাখিটা তখনো বেঁচে। অনেকখন ঘুম এল না তার। যতবারই চোখ বোজে ততবারই পাখির ছবিটা মনে হয়, কীভাবে শুয়ে শুয়ে ধুকপুক করছে পাখিটা।
সকালবেলা খাঁচাটার কাছে এসে সেরিওজা দেখল পাখিটা চিত হয়ে পড়ে আছে, শিটিয়ে কাঠ-কাঠ হয়ে আছে পা।
সেই থেকে সেরিওজা কখনও পাখি ধরে নি।”
(পাখি)
পাখি ধরার খাঁচার ঘটনা কতটা বেদনাদায়ক হতে পারে এটি তার গল্প। মূল বইটিতে কিছু অসাধারণ চিত্র এঁকেছিলে আ. পাখোমভ। দ্যু প্রকাশনীর সংস্করণেও তা রাখা হয়েছে। এতে বইটি অন্য মাত্রা পেয়েছে। লেভ তলস্তয়ের “শিশু কাহিনী” চেনা পরিবেশেরই ভিন্ন এক অর্থ উন্মোচন করে, যা মানবিক হতে শেখায়, কৌতূহলী হতে শেখায়, আরো বেশি করে জীবনকে যাপন করতে শেখায়। বর্তমান সময়ের শিশুদের জন্যেও যা অবশ্যপাঠ্য। আগামীর পাঠকদের জন্যেও।
শিশু কাহিনী
লেখক : লেভ তলস্তয়
অনুবাদ : ননী ভৌমিক
বিষয় : শিশু-কিশোর গল্প
প্রকাশকাল : ২০১৬
প্রকাশক : দ্যু প্রকাশন
দাম : ৮০ টাকা।
বইটি কিনতে চাইলে:
শিশু কাহিনী (Shishu Kahini) – বাহিরানা