বাহিরানা

এহসান হায়দারের পতঙ্গশিকারি ফুল: রূপকের আড়ালে জীবনের পরাগ


এহসান হায়দারের পতঙ্গশিকারি ফুল—তার নতুন কাব্যগ্রন্থ—সমকালীন বাংলা কবিতায় একটি স্বতন্ত্র সংযোজন। আলোর অঘ্রাণ (২০১৬)-এর পর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ হিসেবে এটি পাঠকের কাছে কেবল নতুন কিছু নয়, বরং তার পূর্ববর্তী কবিতার ভুবন থেকে আরও গভীরে, আরও প্রাঞ্জল এক যাত্রা। এহসান হায়দারের কাব্যচিন্তা সবসময়ই রূপকের ভেতর দিয়ে বাস্তবকে ধরতে চায়; শব্দের কণা থেকে তিনি নির্মাণ করেন এমন এক আবহ, যেখানে মানুষ, প্রকৃতি, শহর, প্রেম, নিঃসঙ্গতা এবং ক্ষয়ের মধ্যেও জীবনের পরাগ জমে থাকে। পতঙ্গশিকারি ফুল সেই পরাগেরই নতুন বিস্তার।

তারপর পতঙ্গশিকার শেষে
পৃথিবীতে নেমে আসে আদম-হাওয়া
কৈলাসে-কাঞ্চনে বঙ্গোপসাগরে…

(পতঙ্গশিকার শেষে, পৃষ্ঠা- ৪৭)

এহসান হায়দারের কাব্যে শহুরে চেতনা যেমন আছে, তেমনি আছে ভেতরকার ব্যক্তিগত অস্থিরতার দীর্ঘ প্রতিধ্বনি। তিনি কখনো সরাসরি বলেন না; চিত্রকল্পের আড়ালে রেখে পাঠককে নিজস্ব পথ খুঁজে নিতে দেন। শব্দের ভেতর শব্দ, নীরবতার ভেতর নীরবতা—এই দ্বিবাচনিক রীতিই তাকে আলাদা করে।

এ গ্রন্থের নামেই যেন কবির অভিপ্রায় লুকিয়ে আছে—পতঙ্গশিকারি ফুল, যা আলোয় আকৃষ্ট দুর্বল প্রাণীদের ডেকে নেয় নিজের ভিতর, আবার তাদের জাগিয়ে তোলে পরম বিস্ময়ে। বইয়ের কবিতাগুলোতেও আছে এমনই এক দ্বৈততা—একদিকে মায়া, অন্যদিকে ক্ষত; একদিকে আকর্ষণ, অন্যদিকে তীব্র বোধের চূর্ণ।

নিখুঁত ভোর স্পর্শ ক’রে আলো ফোটে উজ্জ্বল সে
তবু মনে হয়, এই যেন জ্ঞান ও সমান সৌন্দর্য তা
নদীর বহমান স্রোতে ছুটে যায়, পাহাড়ি ঝরনায়ও
সুর তোলে প্রেমে—পরানে; পাতারা গেয়ে ওঠে
পাখিরা উড়ে উড়ে আসে, দূর-সুদূরের পাখিদল
ফুলের মায়ায় নাচে, ডানায় ভর ক’রে উর্বশী—

(আশ্চর্য বৃক্ষ, পৃষ্ঠা- ২৮)

এহসান তার ভাষায় যেমন নরম, তেমনি ধারালো; ছোট ছোট পঙ্‌ক্তিতে তিনি তুলে আনেন বিস্তৃত জীবনচিত্র। তার পূর্ববর্তী কাব্যগ্রন্থে যে স্নায়বিক টান, দার্শনিক মনোভাব এবং আত্মমগ্ন প্রতিফলনের চর্চা দেখি, এখানে তা আরও পরিণত হয়ে উঠেছে।

তুমি ধ’রে আছো টেলিফোন
খুঁজি পুরোনো চিঠি, নকশাল;
আমি ভেবে বলছি—নির্বাসনে
যাবো নিশ্চয়ই, জুতোজোড়া যাচ্ছে
জুতোজোড়া যাচ্ছে আগুন ছাড়িয়ে

(আমার জুতোজোড়া আগুন ছাড়িয়ে গেল, পৃষ্ঠা-৩৫)

এহসান হায়দারের কাব্যে শহুরে চেতনা যেমন আছে, তেমনি আছে ভেতরকার ব্যক্তিগত অস্থিরতার দীর্ঘ প্রতিধ্বনি। তিনি কখনো সরাসরি বলেন না; চিত্রকল্পের আড়ালে রেখে পাঠককে নিজস্ব পথ খুঁজে নিতে দেন। শব্দের ভেতর শব্দ, নীরবতার ভেতর নীরবতা—এই দ্বিবাচনিক রীতিই তাকে আলাদা করে। পতঙ্গশিকারি ফুল-এ তিনি সেই কৌশলকে আরও শাণিত করেছেন। যেন প্রতিটি কবিতাই একটি পৃথক ফুল, যার ভেতর আলো আর অন্ধকার, কামনা আর হাহাকার, সচেতনতা আর স্বপ্ন একসঙ্গে নিঃশব্দে বেড়ে ওঠে।

যে পথে আমি এসেছি,
তা আলোয় পূর্ণ;
যে পথ যাওয়ার তা আলোহীন—

(আসা-যাওয়া, পৃষ্ঠা-২৪)

রাজীব দত্তের করা প্রচ্ছদ গ্রন্থের মুডের সঙ্গে এক অনবদ্য সামঞ্জস্য গড়ে তুলেছে। ফুলের বিমূর্ততা, তার ভেতরের ছায়া আর আলো—সেই চিত্রই যেন বইয়ের মূল প্রতিধ্বনি। কবিতাগুলোর ভেতর যে জৈবিক স্পন্দন, ক্ষুদ্রজীবের গতিবিধি, দহন আর ধ্বংসের প্রতীক—সবই অনায়াসে মিলেছে প্রচ্ছদের রঙশৈলীর সঙ্গে।

রেড লিলি থেকে প্রকাশিত এবং ৩৫০ টাকা মূল্যের এই বই পাঠকের জন্য শুধু একটি কবিতার বই নয়; বরং এক গভীর অভিজ্ঞতা, যেখানে নিজের ভেতরকার অন্ধকারকে ছুঁয়ে দেখা যায়, আবার আলোকিত মুহূর্তগুলোকে ধরে রাখা যায়। এহসান হায়দারের পূর্বের লেখালেখি যারা অনুসরণ করেন, তাদের কাছে এই গ্রন্থ হবে এক নতুন অর্জন; আর নতুন পাঠকদের কাছে এটি হতে পারে তার কবিতাজগতের দরজা খুলে দেওয়ার সূক্ষ্ম প্রস্তাবনা।

পতঙ্গশিকারি ফুল তাই কেবল শব্দের নির্মাণ নয়—এটি কবির মনের জটিল ও মায়াবী ভূগোলের মানচিত্র। তার কাব্যযাত্রার এ পর্যায়ে এসে এহসান হায়দার প্রমাণ করেছেন, তিনি স্বরের পুনরাবৃত্তিতে নয়, বরং স্বরকে নতুনভাবে রূপান্তরিত করায় বিশ্বাসী। সেই রূপান্তরের সার্থক স্বাক্ষরই এই বই।

পতঙ্গশিকারি ফুল: এহসান হায়দার
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
দাম: ৩৫০ টাকা
প্রকাশন: রেড লিলি
প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০২৫


মন্তব্য করুন