নোবেল পুরষ্কারজয়ী আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের গদ্যকে অভিহিত করা হয় পরিচ্ছন্ন বা ক্লিন বলে। তিনি যা বলতে চান তা কম শব্দে, পরিষ্কারভাবে বলতে পারেন তার লেখায়, এই গুণটি সাধনাসাপেক্ষ এবং প্রতিভাজাত। সংক্ষিপ্ত ও নির্মেদ বাক্যে হেমিংওয়ে এমন এক জগৎ গড়ে তোলেন যা দৃশ্যময় কাব্যের মতো পাঠকদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাংলা সাহিত্যে এরকম গদ্যের তুলনা পাওয়া যায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (বিশেষ করে তার উপন্যাস আরণ্যক-এর সঙ্গে হেমিংওয়ের ননফিকশন বইগুলোর গদ্যপ্রবাহের অসাধারণ সমধর্মীতা রয়েছে), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও মাহমুদুল হক-এর সাহিত্যকীর্তীর মধ্যে। অরুন্ধতী রায়ও তার উপন্যাস ও ননফিকশনের ভাষায় হেমিংওয়ের পথ অনুসরণ করেন স্পষ্টবাদিতা ও বাহুল্য বর্জনের সীমানায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারে অংশ নেওয়া ও প্লেন দুর্ঘটনা ও কয়েকবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা, বহু বর্ণিল ও বহুস্বরাত্মক জীবন যাপন করা হেমিংওয়ে তার লেখায় তার যাপিত জীবনের অন্তসার তুলে এনেছিলেন, ফলে তার সাহিত্য বিশ্বমনের অংশ হয়ে গেছে, যা ক্ষয় হওয়ার নয়। ১৮৯৯ সালের জুলাইয়ের ২১ তারিখে জন্ম নেওয়া হেমিংওয়ে বেড়ে ওঠেছিলেন আমেরিকার ইলিনইসে, আর মৃত্যুবরণ করেছিলেন জুলায়ের ২ তারিখে ১৯৬১ সালে। আক্ষরিক অর্থেই তিনি মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন, একদিন সবার অগোচরে বাসার বেসমেন্টে মুখের ভেতর শটগানের মাথা ঢুকিয়ে ট্রিগার টিপে দিয়েছিলেন জীবনের অসহনীয় বিষাদের অবসানকল্পে। কিন্তু এই জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানে তিনি লিখেছেন দু’হাত ভরে, যার সবই অলোকসামান্য। যে লেখা তাকে করে তুলেছিল বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিকদের একজন, আজো তা-ই। লিখেছেন উপন্যাস, অ্যা ফেয়ারওয়েল টু আর্মস (১৯২৯), দ্য সান অলসো রাইজেস (১৯২৬), দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি (১৯৫২), ফর হোম দ্য বেল টলস (১৯৪০) ননফিকশন, ডেথ ইন দ্য আফটারনুন (১৯৩২), গ্রিন হিলস অব আফ্রিকা (১৯৩৫) এবং অনেকগুলো ছোটগল্পসহ আরো অনেক গ্রন্থ।
সান্তিয়াগোর এই আখ্যান যেন আমাদের রবীন্দ্রনাথের সোনারতরী কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়, সব সোনার ফসল মাঝি নিয়ে যায় কিন্তু যার ফসল তাকে রেখে যায়, তরীতে জায়গার বড় অভাব। সান্তিয়াগোর অর্জনকেও কাল নিয়ে গেছে সবার অগোচরে, সবার অলক্ষ্যে, কিন্তু একটি জিনিস রেখে গেছে, যেটা সান্তিয়াগোর জয়ের, অর্জনের সবচেয়ে মোক্ষম প্রমাণ ও পৃথিবীবাসীর কাছের যা সান্তিয়াগোর নীরব জবাব—তা হলো মার্লিন মাছটির কংকাল।
কিন্তু কী তার বিশেষ যা তাকে বিশ্বনন্দিত করেছিল? তার জন্য দেখা প্রয়োজন তার সাহিত্যকেই, সেখানেই লুকিয়ে আছে তার হীরকতুল্য জীবনদর্শন, যা তার প্রতিটি শব্দকে ছুড়ির মতো ধারালো আর প্রকাশসক্ষম করে তুলেছিল। আর এর জন্য আমাদের ডুব দিতে হবে একশরও কম পৃষ্ঠায় সমাপ্ত আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি ঔপন্যাসিকার মধ্যে। হেমিংওয়ে অনেকদিন কিউবায় কাটিয়েছেন, সেখানেই এই আখ্যানটির রসদ সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলোর মধ্যে অন্যতম ও বিশেষ। কারণ এই ঔপন্যাসিকায় তার ভাষা ও আঙ্গিক মহাকাব্যের সহজতা ও গভীর দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছিল। এর টান টান প্রতিটি বাক্যে লাভার মতো যা প্রকাশিত হয়েছে—তার সহজ নাম জীবন বৈ কিছু নয়। এই বইটিতেই তিনি বুড়ো সান্তিয়াগোর মুখ দিয়ে বলিয়েছেন “মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু পরাজিত হতে পারে না।” (দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি)। ঔপন্যাসিকাটি লাইফ ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫২ সালে, এরপর স্ক্রিবনার থেকে পরের সপ্তাহে প্রকাশিত হয় বই আকারে। পত্রিকা দুই দিনে অবিশ্বাস্যরকমভাবে ৫.২ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়, বইও বিক্রি হতে থাকে হাজার হাজার কপি। নয়টি ভাষায় অনূদিত হয় খুবই দ্রুততম সময়ে আর নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলারের স্থান অধিকার করে রাখে প্রায় ৬ মাস। ১৯৫৩-এ পুলিৎজার পুরস্কার জিতে নেয়। আর ১৯৫৪ সালে গদ্যের নিপুণ ব্যবহার ও দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি এর জন্য হেমিংওয়ে জেতেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।
এই ক্ষুদ্র কলেবরের বইটির কাহিনিও সংক্ষিপ্ত, কিউবার বুড়ো জেলে সান্তিয়াগো টানা ৮৪দিন সমুদ্রে মাছের দেখা পায়নি, সমুদ্রপাড়েই এক ঝুপড়িতে সে দিন কাটায়। একজন অভিজ্ঞ মাছশিকারীর জন্য এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর হয় না। লোকমুখে গুঞ্জনে, গুঞ্জনে ছড়িয়ে পড়লো তার অসফলতার কাহিনি। তবু সে দিনমান মনে মনে সংকল্প দৃঢ় করে, আশার ও স্বপ্নের জাল বুনে, তার যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করে। কিশোর মানোলিনও আরেক চরিত্র এই ঔপন্যাসিকার, সান্তিয়াগোর শিষ্য সে, তার গুরুর দুর্ভাগ্যের কারণে পরিবারের চাপে তাকে সদ্য অন্যখানে কাজ দেখতে হয়েছে। কিন্তু তাদের যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন আছে। বুড়ো সান্তিয়াগোর প্রিয় খেলা বেসবল, সে এই খেলার সব খবর রাখতে চেষ্টা করে, সেসব নিয়ে গল্প করে। খেলাটি যেন তার যুবক বয়সে ফেরার এক প্রতীক, পুরো আখ্যানেই মাঝে মাঝেই এই খেলার বিভিন্ন প্রসঙ্গের দেখা পাই আমরা।
তারপর ৮৫তম দিনে সান্তিয়াগো আবার সমুদ্রযাত্রা করে। একা। অন্য মাছশিকারীদের চেয়ে আরো সমুদ্রগভীরে চলে যায় সে। অবশেষে সে মাছের দেখা পায়, তার বড়শিতে ধরা দেয় এক বৃহৎ মার্লিন মাছ। যার আয়তন তার নৌকোর চেয়েও বড়, এত বড় মাছ এই সমুদ্রাঞ্চলে কারো কাছে ধরা পড়েনি কখনও। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখনই, সে মাছটিকে করায়ত্ত করতে পারে না, উল্টো মার্লিনটিই তাকে আরো গভীর পাথারে টেনে নিতে উদ্ধত হয়। সান্তিয়াগোর বয়সের ভার, তবু তার প্রজ্ঞা ও হার না মানার মানসিকতা তাকে জয় ও পরাজয়ের মাঝে দুলাতে থাকে। সে এক অসম যুদ্ধ করতে থাকে। এই অবিরাম যুদ্ধের মাঝেই সান্তিয়াগো নিজেই নিজেকে সাহসের বাণী শোনায়, মাঝে মাঝে কিশোর মানোলিনের কথা স্মরণ করে, ভাবে যদি মানোলিন এখন থাকত তাহলে কাজের কাজ হতো। এক বেসবল খেলোয়াড়ের কথাও ভাবে—উদ্দম ধরে রাখতে। এসব উপায়ে সে উদ্দীপ্ত রাখে নিজেকে।
অবশেষে দীর্ঘ-দীর্ঘক্ষণ যুঝতে যুঝতে সে মার্লিনটিকে বাগে আনতে সক্ষম হয়। যদি এই মাছ নিয়ে সে ফেরে তাহলে সে প্রবাদে পরিণত হবে সেই লোকদের কাছেই, যারা তার অসফল মাছশিকারকে সালাও (দুর্ভাগ্য) আখ্যা দিয়েছিল। বুড়ো সান্তিয়াগো অবশেষে সফল হয়, সে মাছটিকে নিয়ে তীরের দিকে ফিরতে শুরু করে, মাছটির থেকে কোনোপ্রকার বাধা ছাড়াই। কিন্তু যা হওয়ার তা ঘটে গেছে ইতোমধ্যে, এই মার্লিনের সঙ্গে অসম সাহসী লড়াইয়ে সে কখন সমুদ্রের গভীরে চলে গেছে সে জানতেও পারেনি। তাই তার ফেরা আরেক যুদ্ধের দিকে তাকে ঠেলে দেয়। সে এই লড়াইয়ে যে জয় পেল, যে অর্জন সে পেল, যা তার আগে কোনো মাছ শিকারী পায়নি, সেই মার্লিনকে অক্ষত অবস্থায় নিয়ে সে সমুদ্রতীরে ফিরতে পারবে তো? এই ফেরা যেন দুরাশায় রূপ নেয়, কেননা মার্লিনটি স্পন্দনহীন, নিঃসাড়, তাই অন্য শিকারী হাঙরেরা তাকে ঠুকরাতে শুরু করে, তার মাংস খসিয়ে নিতে শুরু করে। ফেরা যতই দীর্ঘ হতে থাকে মার্লিনের মাংস ততই কমতে শুরু করে। সান্তিয়াগো বহু চেষ্টা করে, কিন্তু এত এত ক্ষুধার্ত হাঙরের কবল থেকে মার্লিনটিকে রক্ষা করা অসম্ভব। সে হাল ছাড়ে না, আরেক যুদ্ধে পড়ে এবং একটি বড় হাঙরকে মারতে সক্ষম হয়, সে বলে এ তার দেখা সবচেয়ে বড় “dentuso” (বড় দাঁত বিশিষ্ট হাঙর)। যখন তার নৌকো অবশেষে তীরে ভেড়ে তখন নৌকোর সাথে লেগে আছে শুধু এক মার্লিনের কংকাল, এর শরীরের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, সব খেয়ে ফেলেছে হাঙরেরা। সান্তিয়াগোর এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, সে ধীরস্থিরে তার ঝুপড়িতে ফিরে যায়। এভাবেই শেষ হয় ঔপন্যাসিকাটি।
সান্তিয়াগোর এই আখ্যান যেন আমাদের রবীন্দ্রনাথের সোনারতরী কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়, সব সোনার ফসল মাঝি নিয়ে যায় কিন্তু যার ফসল তাকে রেখে যায়, তরীতে জায়গার বড় অভাব। সান্তিয়াগোর অর্জনকেও কাল নিয়ে গেছে সবার অগোচরে, সবার অলক্ষ্যে, কিন্তু একটি জিনিস রেখে গেছে, যেটা সান্তিয়াগোর জয়ের, অর্জনের সবচেয়ে মোক্ষম প্রমাণ ও পৃথিবীবাসীর কাছের যা সান্তিয়াগোর নীরব জবাব—তা হলো মার্লিন মাছটির কংকাল। কাল তা নেয়নি, সাক্ষ্য দিয়েছে জয়ের। তবে এও বলেছে, কোনো অর্জনই চিরকাল ধারণ করা যায় না, হোক না তা এই সমুদ্রস্থানের সবচেয়ে বড় মাছশিকারই, কাল তা গ্রাস করবেই। কিন্তু গল্প হিসেবে যা থেকে যাবে চিরকাল তা হলো সেই শিকারের সময়ে জীবন সাগরের নীল, অতল ও প্রস্বর ভয়ের মুখে সাহস না হারিয়ে করা যুদ্ধের গল্পটি। যা কখনও মুছে যাবে না। সান্তিয়াগোর গল্পটিও হারাবে না, বরং যুগ যুগ ধরে নতুন নতুন বিভিন্ন আবিষ্কারের অভিমুখী অভিযাত্রীদের তা প্রেরণা যোগাবে।
পৃথিবীতে যত মহাকাব্য লেখা হয়েছে সবগুলোতেই একটি বিষয় দেখা যায়, তা হলো যাত্রা—ইলিয়াড, ওডিসি, রামায়ণ, মহাভারত, ভার্জিলের ঈনিদ, ইনকাদের পোপ্লভো, দান্তের ডিভাইন কমেডি—সবগুলো মহাকাব্যেই বিষয় বৈচিত্র নিয়েই তারা একটি বিষয়ে সমগুণসম্পন্ন তা হলো তাদের মধ্যে একটি যাত্রা বা ভ্রমণ রয়েছে। এই যাত্রাটি রূপকার্থে আমাদের জীবনকেই বোঝায়, জীবনেও ভ্রমণ রয়েছে, রয়েছে সীমার মাঝে অসীমকে স্পর্শ করার যাত্রা। একেই মহাকাব্যগুলোতে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে দেখা যায়। এই যাত্রাটির উল্লেখের কারণ ইতোমধ্যেই আমাদের পূর্ব আলোচনাতেই আছে, যে, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি-তে সান্তিয়াগোর মার্লিন মাছ শিকার অভিযানও এক যাত্রা। রূপকটিকে এভাবে দেখা যায়, তার মাছ শিকারে যাওয়া জীবনের স্বপ্নে বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়া, আর শিকার করা হলো চাওয়ার সমাপ্তি মানে লক্ষ্যপূরণ, আর সেই মার্লিন মাছটিকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ে তীরে না ফিরতে পারাটার মানে উপরে বলেছি, যে, কোনো অর্জনই সম্পূর্ণভাবে ধরে রাখা যায় না, কাল তা তার অধীনে নিয়ে নেয়। যা থাকে তা হলো সেই অর্জনের গল্প, যা মার্লিন মাছের কংকাল। এ-ই জীবনের চরম সত্য, স্বপ্ন ছাড়া মনুষ্যজীবন কোনো মহৎ উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারে না, অসম্ভব জেনেও মানুষ স্বপ্নের পেছনে ছোটে। কারণ যাত্রাতেই, স্বপ্নের জন্য জীবনকে বাজি ধরতে পারাতেই জীবনের মহত্ত্ব। এই বিষয়টিই হেমিংওয়ে বুড়ো সান্তিয়াগো আর মার্লিন মাছের মাধ্যমে আমাদের দেখিয়েছেন। সান্তিয়াগোর মুখ থেকে তাই উচ্চারিত হয় বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উদ্ধৃত বাক্যের একটি, “But man is not made for deafet” (মানুষ পরাজিত হতে পারে না)। আমি এখানে পুরো অংশটিই তুলে দিয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি-এর আমার আলোচনায় আমার মত যতি টানছি।
“But I killed the shark that hit my fish, he thought. And he was the biggest dentuso that I have ever seen. And God knows that I have seen big ones.
It was too good to last, he thought. I wish it had been a dream now and that I had never hooked the fish and was alone in bed on the newspapers.
But man is not made for defeat.’ he said. ‘A man can be destroyed but not defeated.’”
(The Old man and the sea)
দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি
লেখক: আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
বিষয়: উপন্যাস
প্রথম প্রকাশ: ১৯৫২
প্রকাশক: স্ক্রিবনার।