বাহিরানা

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ছদ্মবেশে চিলেতে: মিগুয়েল লিতিনের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা: স্বৈরতন্ত্রের দিনপঞ্জি


আগোস্ত পিনোচেতের আমলে চিত্রপরিচালক মিগুয়েল লিতিনের শ্বাসরুদ্ধকর চিলি ভ্রমণ নিয়ে এই বই। লিতিন সেখানে একটি ডকোমেন্টারি বানাতে চিলি গিয়েছিলেন। তার অভিজ্ঞতার প্রথম পুরুষে পুর্নলিখনই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ছদ্মবেশে চিলেতে: মিগুয়েল লিতিনের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা প্রতিবেদনটি। মার্কেসের সাংবাদিকতার সবচেয়ে উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই বইকে।

লাতিন আমেরিকার ১৯৬০ এর দশকের বুম জেনারেশনের শক্তিশালী প্রতিনিধি ছিলেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (কলম্বিয়া), হুলিও কোর্তাজার (আর্হেন্তিনা), কার্লোস ফুয়েন্তেস (মেক্সিকো)। পরস্পর বন্ধুও ছিলেন তার জীবনের বেশিরভাগ সময় (ফুয়েন্তেসের সঙ্গে মার্কেসের ঝগড়া বিখ্যাত হয়েছিল) তারা পুরো লাতিন সাহিত্যেরই নকশা বদল করে দিয়েছিলেন। বুম জেনারেশনের উত্থানের সময়পর্বটি লাতিন আমেররিকার রাজনীতিরও অস্থিরদশা ছিল। তার ফলাফল এই জেনারেশনের  সাহিত্যিকদের কাজে বিরাট প্রভাববিস্তারী হয়েছিল।

তাই মনে হয়, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ছদ্মবেশে চিলেতে: মিগুয়েল লিতিনের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা  বইটি তাদের সময়ের অস্থিরদশারই এক চিত্রণ যেন। আমরা দেখতে পাই, বইটিতে উঠে এসেছে পিনোচেতের আমলে সে দেশের সাধারণ মানুষের উপর ঘটা মর্মান্তিক সব ঘটনা, যেগুলোকে দুর্ঘটনা বলাই শ্রেয়। এই বই লেখার ঘটনাটিও চাঞ্চল্যকর, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৮২ সালে, আর এর ঠিক ৪ বছর পর ১৯৮৬ সালে মিগুয়েল লিতিনের সঙ্গে ১৮ ঘন্টার ইন্টারভিউয়ের উপর ভিত্তি করে তিনি লিখেছিলেন বইটি।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস নিজের কথাসাহিত্যিক পরিচয়ের চেয়েও সাংবাদিক পরিচয়কে গুরুত্ব দিতেন বেশি। মার্কেসের স্ক্যান্ডাল অব দ্য সেঞ্চুরি বইটিতে তার সাংবাদিকতার ইতিবৃত্ত পেয়েছি আমরা। সেই বইয়ের ৫০টা রিপোর্টিং তার ফিকশনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং বলা যায় সেগুলোতে ধরা আছে তাছে সাহিত্যিক হওয়ার গোপন বিবরণ। আর ছদ্মবেশে চিলেতে: মিগুয়েল লিতিনের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা প্রতিবেদনটিকে বলা যায় তার সাংবাদিকতার শীর্ষ শেখর। এই প্রতিবেদনে তিনি তার বন্ধু লিতিনের স্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন পুরোদমে। লিতিনের ছদ্মবেশে চিলি ভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীবাসীর কাছে পুরো লাতিন আমেরিকার স্বৈরতন্ত্রের রূপ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

লিতিন মার্কেসকে তার চিলি যাত্রা নিয়ে একবার বলেছিলেন, “এটা আমার জীবনের সবচেয়ে নায়কোচিত কাজ না হতে পারে, কিন্তু এটা আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কাজ।” কেন হবে না? কারণ তার এই শ্বাসরুদ্ধকর যাত্রা পাঠকদেরও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করে। পরাধীনতার, গুম-খুনের যন্ত্রণার মুখোমুখি করে।

১৯৬০ সালের শুরুর দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন লিতিন, তার তখন গ্রাম এলাকায় হত্যাযজ্ঞ নিয়ে চলচ্চিত্র ‘চাকাল দে নাহোয়েলটরো’কে বিংশ শতাব্দীর লাতিন আমেরিকার সেরা চলচ্চিত্রের একটি বিবেচনা করা হয়। এরপরই বামদের সুনজরে পড়েন তিনি। সালভাদর আলেন্দে ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তাকে চিলি ন্যাশনাল সিনেমা একাডেমির পরিচালক নিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু ১৯৭৩ সালেই সব পাল্টে যায় পিনোচেত ক্ষমতায় এসেই লিতিনকে জোরপূর্বক নির্বাসনে পাঠান। তিনি এরপর আর দেশে ফিরতে পারেননি, যতক্ষণনা ১০ বছর পর তিনি চিলিতে একটি চলচ্চিত্র বানানোর পরিকল্পনা করেন, পিনোচেতের গোয়েন্দা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে। সেইকাজে তিনি ফরাশি, ইতালিয়ান, ডাচ সিনেমাটোগ্রাফারদের চিলির বিভিন্ন অংশে পাঠান, গোয়েন্দাদের সন্দেহ এড়ানোর জন্য। আর নিজে উরুগুয়ের একজন ব্যবসায়ী হিসেবে চিলিতে প্রবেশ করেন।

এই চলচ্চিত্রের প্রতিটি দলেরই দায়িত্ব ছিল স্বৈরশাসনের সময়কার মানুষের জীবনের প্রকৃত চিত্র তুলে আনা, রাষ্ট্রীয় মিডিয়া যেরকমভাবে দেখায় সেরকম নয়। এরই সত্য বর্ণনা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ছদ্মবেশে চিলেতে বইটি। ফলে বইটি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক রহস্যউপন্যাসও। লিতিন মার্কেসকে তার চিলি যাত্রা নিয়ে একবার বলেছিলেন, “এটা আমার জীবনের সবচেয়ে নায়কোচিত কাজ না হতে পারে, কিন্তু এটা আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কাজ।” কেন হবে না? কারণ তার এই শ্বাসরুদ্ধকর যাত্রা পাঠকদেরও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করে। পরাধীনতার, গুম-খুনের যন্ত্রণার মুখোমুখি করে।

তুষার তালুকদার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ছদ্মবেশে চিলেতে: মিগুয়েল লিতিনের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা বইটির অসাধারণ ও বিশ্বস্ত অনুবাদ করেছেন। তার ভাষা ঝরঝরে, স্বচ্ছ। তাই কোনোধরণের বাধাবিপত্তি ছাড়াই দ্রুত পড়ে যাওয়া যায়। বইটির মাধ্যমে বাংলাদেশেরও সমমাত্রিক ঘটনার অর্থোদ্ধার করা সম্ভব, তাই বইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক, স্বৈরতন্ত্রকে গভীরভাবে জানতে, বুঝতে।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তার জাদুবাস্তববাদী গল্প ও উপন্যাসে যেভাবে কথাসাহিত্যে নতুন আঙ্গিক এনেছিলেন তার রেশ কাটেনি, বরং বাড়ছে। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হক বাহিরানা Talk-এ গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের কথাসাহিত্যকে চিরায়তের অন্তর্গত বলে উল্লেখ করেছেন।

ছদ্মবেশে চিলেতে : মিগুয়েল লিতিনের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা
লেখক : গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
অনুবাদ : তুষার তালুকদার
বিষয় : ভ্রমণ
প্রকাশকাল : ২০২৩
প্রকাশক : বাতিঘর
দাম : ৩২০ টাকা ২০% ছাড়ে ২৫৬ টাকা।

ছদ্মবেশে চিলেতে: মিগুয়েল লিতিনের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা বইটি কিনতে চাইলে


মন্তব্য করুন