বাহিরানা

খুশবন্ত সিংয়ের ট্রেন টু পাকিস্তান: দেশভাগের জাদুবাস্তব ‍উপাখ্যান


ব্রিটিশভারতের দেশভাগ নিয়ে যত সাহিত্য রচিত হয়েছে তার মধ্যে খুশবন্ত সিংয়ের ট্রেন টু পাকিস্তান অন্যতম। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। বলা যায় সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের গভীরতা ও ব্যপ্তি, মানুষে মানুষে সম্পর্কসহ যত ধরণের উপাদান দেশভাগের সঙ্গে যুক্ত—তার সবই এই একটি উপন্যাসে পাওয়া যায়। এই বইয়ের বিষয়বস্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সঙ্গে আরেক খ্যাতিমান উর্দু সাহিত্যিক সাদাত হাসান মান্টো’র বিষয়বস্তুর মিল পাওয়া যায়। মান্টুর বিখ্যাত “ঠান্ডা গোশত”, ”টোবাটেক সিং” গুল্পগুলো এই দাঙ্গার বিপদজনক ও অভাবিত মোড় তুলে ধরেছিল আমাদের সামনে। ট্রেন টু পাকিস্তান বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, একটু আগ বাড়িয়ে বললে বলা যায় বাংলা ভাষায় নতুন রূপ দিয়েছেন তিনি এই সাহিত্যকর্মটির। বইটি প্রথম প্রকাশ করেছিল নালন্দা, বর্তমান সংস্করণ প্রকাশ করেছে প্রকাশনী সংস্থা ঐতিহ্য। খুশবন্ত সিংয়ের ট্রেন টু পাকিস্তান-এর মতোই সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গার উপর আরেকটি গল্প আছে কৃষণ চন্দরের পেশাওয়ার এক্সপ্রেস নামে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সঙ্গে দুই লেখাতেই ট্রেনের কথা আছে, তবে দুই লেখকের নির্মাণই স্বতন্ত্র। কৃষণ চন্দরের গল্পে আমরা পাই, পেশাওয়ার থেকে ছেড়ে আসা পাঞ্জাবগামী একটি ট্রেনের কথা, সে নিরাসক্তভাবে বর্ণনা করতে থাকে তার মধ্যে ঘটতে থাকা সাম্প্রদায়িক হত্যাগুলোর বিষয়ে। তার বর্ণনা পড়তে পড়তে মানবসভ্যতা নিয়েই আমাদের ভেতর বিবমিষা জাগতে থাকে।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মাকোন্দো গ্রামের জাদুবাস্তবতার নিদর্শন যেন লাশ ভর্তি হয়ে আসা ট্রেন। মার্কেজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার সব গল্পই বাস্তব। এর প্রমাণ পাওয়া যায় খুশবন্ত সিংয়ের ট্রেন টু পাকিস্তান উপন্যাসে, যে বাস্তবও কেমন জাদুবাস্তব হয়ে উঠতে পারে।

খুশবন্ত সিংয়ের ট্রেন টু পাকিস্তান  উপন্যাসের কাহিনির কেন্দ্র, ১৯৪৭ সালে যখন ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেছে, তখন মানো মাজরা নামের একটি শান্ত গ্রাম, যেখানে মুসলিম এবং শিখদের আধিক্য। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের এক রেল স্টেশনের পাশের এই গ্রামটি কীভাবে অশান্ত হয়ে উঠে তারই বয়ান হাজির করেছেন খুশবন্ত সিং। গ্রামের অধিবাসীরা গান্ধীর ব্যাপারে কিছু জানলেও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে চিনে না। রাম লাল নামে সুধী কারবারীর বাড়িতে হঠাতই একদিন ডাকাতি হয়, রাম লালকে মেরে ফেলে ডাকাতরা। আর সেখান থেকেই পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। জগৎ সিং বা জাগ্গু যে এলাকাটির ভয়কর লোক হিসেবে পরিচিত তার প্রেম এক ইমামের মেয়ে নুরানের সাথে। ডাকাতরা যাওয়ার সময় তার বাড়িতে ডাকাতির একটি ভাগ ফেলে যায়। তার প্রেমিকা তাদের একজনকে দেখেও ফেলে, জানা যায় তার নাম মালি। পরদিন ম্যাজিস্ট্রেট এসে পৌঁছায়। সে খোঁজ খবর করে ধর্মীয় কোনো দাঙ্গা হয়েছে কীনা। একসময় সে সাব ইন্সপেক্টরকে একজন পতিতার ব্যবস্থা করে দিতে বলে।

একদিন গ্রামটির ভয় ও অস্থিরতার সব সীমা অতিক্রম করে যায় যখন শিখদের লাশভর্তি একটি ট্রেন এসে পৌঁছায় রেল স্টেশনে। মানো মাজরার মানুষের পারস্পরিক সহাবস্থান নষ্ট হয়ে যায়, শিখ-মুসলিম-হিন্দুদের পরস্পরের মধ্যে জন্ম নেয় বিদ্বেষ, ভয়। গ্রামবাসীদের ধারণা, পরের ট্রেনটি আসবে মুসলমানদের লাশ নিয়ে। জগৎ সিং অস্থিরচিত্ত আর উৎকণ্ঠায় ভাবে তার প্রেমিকাও ওই ট্রেনে থাকবে, কারণ সে তো মুসলমান।

প্রেম, ধর্ম, সম্পর্ক, দেশভাগের নিষ্ঠুরতা, জন্মস্থান হারানোর বেদনা, মানুষের চিরায়ত দ্বিধা ও ভালোবাসা আর ভূরাজনীতির প্রভাবে সবকিছুই ধ্বংসের মুখে পড়ে যাওয়া এক গ্রাম মানো মাজরা। যে গ্রাম আমাদের খুব চেনা এখনও, যেহেতু এখনও দেশে দেশে গ্রামটির শান্তি সাক্ষাৎ দোজখে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। খুশবন্ত সিং আমাদের সেই গল্পই বলেন, জটিল-কুটিল, সহজ-সাধারণ অজস্র চরিত্রের মাধ্যমে।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মাকোন্দো গ্রামের জাদুবাস্তবতার নিদর্শন যেন লাশ ভর্তি হয়ে আসা ট্রেন। মার্কেজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার সব গল্পই বাস্তব। এর প্রমাণ পাওয়া যায় খুশবন্ত সিংয়ের ট্রেন টু পাকিস্তান উপন্যাসে, যে বাস্তবও কেমন জাদুবাস্তব হয়ে উঠতে পারে।

জাগ্গুর হৃদয়ে নুরানকে হারানো ভয় যেন সেই চিরকালীন মানুষেরই গল্প, যারা সমাজ-রাষ্ট্রের লোভের কাছে অসহায় হয়ে যায়। তাই এই উপন্যাসটি মানুষের সুখ-দু:খে একান্ত ছবি হয়ে ওঠে। ট্রেন টু পাকিস্তান হয়ে ওঠে দূষিত সমাজের এক রূপক।

খুশবন্ত সিং তার দীর্ঘ জীবনে (২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫ – ২০ মার্চ ২০১৪) অসংখ্য বই লিখেছেন, সেসব বৈচিত্রেও সম্মৃদ্ধ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, ইতিহাসগ্রন্থ: দ্য শিখস (১৯৮৪), গদ্য ও প্রবন্ধ:  দিল্লি নগরের উৎসব ও ঋতুর পরিক্রমা এবং দিল্লিতে তার দেখা মানুষদের নিয়ে দিল্লি থ্রো দ্য সিজনস, তার দীর্ঘ কর্মজীবনে যেসব জায়গায় তিনি গেছেন, যেসব মানুষদের সাথে মিশেছেন, যা যা দেখেছেন, সেসব নিয়ে চমৎকার এক বই মেলিশিয়াস গসিপ।  গল্পগ্রন্থ: দ্য পোট্রেট অব অ্যা লেডি, দ্য স্ট্রেইন। উপন্যাস: আই শ্যাল নট হিয়ার দ্য নাইটিঙ্গেলস (১৯৫৯)। এই বইগুলো পাঠকদের কাছে গভীরতর অর্থে একজন লেখকের যাত্রাপথকে দৃশ্যমান করে তোলে। ট্রেন টু পাকিস্তান এর বিভীষিকা কাটাতে খুশবন্ত সিং-এর বর্ণনায়  স্বর্গীয় নগর দিল্লির ঋতুর শোভা আমাদের ক্ষতের যেন কিছুটা উপশম ঘটায়। আর যদি বলা হয় হৃদয়ে চিরস্থায়ী ভাগের ক্ষত—তার উপশম নেই। কারণ দিল্লির বসন্তের শোভা দেখতে পায় না বহু মানুষ, যাদেরকে উদ্বাস্তু করে ভিন্ন দেশে পাড়ি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। পাকিস্তানের লাহোরের কথাও তো একই, এই নগর থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়েছে বহু বহু মানুষ। তাদের বেদনার রয়েছে হাজার-লাখো গল্প। খুশবন্ত সিংয়ের ট্রেন টু পাকিস্তান-ও তাই।

ট্রেন টু পাকিস্তান
লেখক : খুশবন্ত সিং
অনুবাদক : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
বিষয় : অনুবাদ উপন্যাস
প্রকাশক : ঐতিহ্য
প্রকাশকাল : ২০২৫
মূল্য : ৩৯০ টাকা।

বইটি কিনতে চাইলে:

ট্রেন টু পাকিস্তান (Train To Pakistan) – বাহিরানা


মন্তব্য করুন