দিপু চন্দ্র দেব
কবিতা শব্দের মধ্যে অনির্বচনীয়তা, রহস্য, ঐতিহ্য, বিস্ময়, প্রাত্যহিকতা, চিরন্তন বিশ্ব এসবই জড়িয়ে আছে। আরো ভালোভাবে বললে কবিতার মর্মমূলে পুরো বিশ্বটিই গেঁথে আছে। কিন্তু আমরা বিশ্বের দিকে তাকালে দেখতে পাই, সেটি বদলে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, প্রতি আবর্তে, ঘূর্ণনে তার মাঝে নতুন কিছু যুক্ত হচ্ছে, পুরোনো নক্ষত্র খসে পড়ছে, হয়তো কোথাও জন্ম নিচ্ছে নতুন নক্ষত্র। কবিতা যদি এই বিশ্বকে ধারণ করে তবে, তারও রূপান্তর অনিবার্য, তার অর্থ হলো প্রতিটি কবিতাই নতুন। আমরা প্রচলের মনে থাকা অর্থ প্রাধান্যকে তুষ্ট করতে বলি ভালো কবিতা, মন্দ কবিতা—কেননা এ ছাড়া তারা বুঝতে পারে না। কিন্তু কবিতায় ভালো বলতে বোঝায় যেটি মন্দ হয়নি, মানে হচ্ছে এটাকে কবিতা পদবাচ্য বলে মেনে নিতে হবে, কাঁচা কবিতা বলা যাবে না। আর মন্দ কবিতা থেকে আবার কাঁচা শব্দটি বাদ দিতে হবে, কাঁচা হাতের লেখায় কবিতার ভালোরকম উপাদান থাকতে পারে, যেগুলো সুপ্ত থাকে, কিন্তু মন্দ কবিতায় সেই সম্ভাবনা নেই। তাহলে এর বাইরে কবিতাকে অব্যর্থভাবে চিহ্নিত করতে পারে এমন শব্দবন্ধ কোনটি? সেটি হলো “নতুন কবিতা”। এই শব্দবন্ধ দিয়ে কবিতার প্রকৃত যাত্রা শুরু হয়, “নতুন” বলেই প্রচলিত সমালোচনার খোপে সে ধরা দেয় না। এই কবিতাগুলোই স্থায়ীত্বের বীজ বা অমরতার বীজ ধারণ করে। এই বিষয়ভাবনাগুলো অবতারণা করতে হলো রনক জামানের “এই গ্রাম কুড়িয়ে পেয়েছি” বইটির জন্যে। কারণ এই বইয়ের কবিতাগুলো মর্মগতভাবে নতুন।
এই কবির কবিতার বিশেষ করে এই বইটির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দুইটি বা ততোধিক ঘটনার আপাত বৈশাদৃশ্যকে (বিষয়টিকে ঘটনার মেজাজ বা আবহের বৈপরীত্য হিসেবে দেখলেই ভালো) একটি কবিতায় ধারণ করা। কিন্তু তাদের বৈপরীত্য এখানে বাধা না হয়ে বরং নতুন অর্থের জন্ম দেয়। এই প্রক্রিয়ায় কোনোরূপ বাড়তি জোর নেই, স্বতস্ফুর্তভাবে ঘটে, তাই অভিনবত্ব আসে।
ভাষার দখল কবিতার বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এটি সচেতনভাবে আসে না, শুধুমাত্র থাকে, কবিত্বের মতো, কবির ভেতরে। ব্যাকরণ জাতীয় কিছু নয় এটি, এর মধ্যে একটি গোপন উপাদান আছে যেটি চোখে পড়ে না পাঠকদের। গোপন বিষয়টি হলো কবি যা বলছেন সেটি তিনি নিজে বিশ্বাস করছেন, আর সেটিকেই তিনি ভাষায় প্রকাশ করছেন। পাঠক যখন চেনা বস্তুবিশ্বের অচেনা উপস্থাপনার মুখোমুখি হয়ে বিস্মিত হন, তখন এই বিশ্বাস জিনিসটাই সেটা সম্ভব করে। কারণ কবি তাদের ভেতর এই প্রতীতি জাগান—এটা সত্য। রনক জামান যখন স্বতস্ফুর্তভাবে বিস্মিত করে বলেন,
দূর, খালজুড়ে কচুরিপানার বুদ্বুদ
লগি, অন্তরীক্ষ ছিঁড়ে উড়ে যাবে চাঁদের পাশে
কোষানৌকায়, ক্লান্ত ধীবর—অবিকল যিশুখ্রিস্টের মতো, জলের উপর দিয়ে
হেঁটে যাচ্ছে
(ধীবর পল্লী, এই গ্রাম কুড়িয়ে পেয়েছি)
তখন পাঠক বিস্ময়ের ঘোরে অন্য এক বাস্তবতায় উপনীত হয়ে বিশ্বাসের অপার ঔজ্জ্বল্যে অবগাহন করেন। সাধারণের ভাষা উলট-পালট হয়ে যায়। প্লেটো তার আদর্শ নগর থেকে একারণেই কবিদের বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন হয়তো, কারণ তারা ভাষাকে ভেঙেচুরে ফেলেন। এরকম পঙক্তি আরো অনেক আছে বইটিতে, আরেকটি উদাহরণ কাম্য,
একা, অন্ধ লোকটি আজ—
নিজেরই চেহারা ভুলে
একটি আয়না হাতে, একা একা হাসছে আপাদমস্তক।
…
আর রোজ একা একা
পিছু নেয় রোদটির—
তারাটির কাছাকাছি একদিন পৌঁছে যেতে
(অন্ধ, ঐ)
অন্ধ লোক যদি জন্ম থেকেই অন্ধ হয় তাহলে সে শুধু আয়নার কথা শুনেছে, কখনও দেখেনি, কিন্তু যদি বস্তুজগতের দর্শন পাওয়ার পর অন্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তার বেদনা ও হতাশা এই বাক্যগুলোয় উঠে এসেছে, যেহেতু দ্বিতীয় লাইনের “নিজেরই চেহারা ভুলে” বাক্যটি বলে লোকটি নিজের চেহারা আগে দেখেছে। সে একা, এর কারণ হতে পারে কোনো দু:সময়ে সে সবাই ও সবকিছুকে হারিয়েছে। তবে এ অসম্ভব কিছু নয়, নিত্যই এমন হতে পারে, কিন্তু রোজ একা একা যখন রোদটির পিছু নেয় সে, তখন কবিতাটি পূর্ণভাবে ধরা দেয় নতুন হয়ে। আবার এসবই হতে পারে, হচ্ছেও, কিন্তু কবিতাটির “নতুন” কোথায়? অর্থগঠনের কোন জায়গায় সে আঘাত করে? সেটি হচ্ছে,
“নিজেরই চেহারা ভুলে
একটি আয়না হাতে, একা একা হাসছে আপাদমস্তক” একটি আয়না হাতে সে কী দেখছে, বা যদি পরিহাসের ছলেও সে আয়নায় না তাকিয়ে শুধু হাতে নিয়ে রাখে, তবু সেখানে কিছু না কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কী দেখা যাচ্ছে তা আমরা জানতে পারি না। সেটি যে কবি আমাদের জানাচ্ছেন না, এই জায়গাটিতে তৈরি হচ্ছে বহুঅর্থ, তাও খুবই সুক্ষ্ণভাবে। কারণ, “আয়না” এখানে ক্ষমতা কাঠামোর রূপ নিয়েছে, আয়নাই ছদ্মবিশ্ব, কিন্তু লোকটি এই ক্ষমতাকে কী প্রত্যাখ্যান করছে? ফলে পূর্বে ধারণকৃত আমাদের স্থির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হচ্ছে, এখন সবকিছুই অনিশ্চিত, লোকটি হয়তো আদতে অন্ধই নয়। এরকম বহুকিছুই তৈরি হয়। আয়না তার মধ্যে থাকা অপরিসীম সম্ভাবনার দরোজাগুলো দিয়ে সব জানা অর্থকেই রহস্যের মোড়কে বদলে দিচ্ছে। রনক জামানের কবিতায় এভাবে প্রায়শই বহুঅর্থবোধকতা তৈরি হয়। এখানে বলা প্রয়োজন কবিতা প্রাত্যহিক বাস্তবতাকে ব্যবহার করে তার অর্থ বদলে দিতেই, এই কবিতাটি তার উৎকর্ষপূর্ণ উদাহরণ ধারণ করছে।
২.
বইটির বিষয়বস্তুতে “গ্রাম” একটি বৃহৎ জায়গাজুড়ে আছে (শহরও আছে), বাংলা সাহিত্যের পরিসরজুড়ে দেখলে, জসিম উদ্দিন ও আল মাহমুদের কবিতায় যে গ্রামের দেখা আমরা পাই—সেসবের ভাষাভঙ্গিসহ কোনোকিছুই রনক জামানের গ্রাম বিষয়ের কবিতায় মেলে না। তিনি গ্রামকে চূর্ণ করে দেখেন, প্রথমে তিনি গ্রামের বাস্তবতাতে প্রবেশ করেন তারপর তার মধ্যে থাকা দৃশ্য-অর্থের চূর্ণগুলোকে নতুনভাবে বের করে আনেন। আল মাহমুদের গ্রাম যদি আধুনিক হয়, তাহলে রনক জামানের গ্রাম উত্তরাধুনিকতার সাক্ষ্য বহন করছে, কেননা আল মাহমুদ গ্রাম থেকে বিতারিত হয়েছেন নগরে, কিন্তু রনক জামানের উল্লেখিত গ্রামে এসবের কোনো ইঙ্গিত নেই। তিনি পর্যবেক্ষণকারী, বলা ভালো, তিনিও শহর বহন করছেন, কিন্তু সেই শহর কোন্ প্রকারের সেটির কোনো স্থির নিশানা নেই। যেটা আল মাহমুদে আমরা পাই। গ্রাম ছেড়ে আসা আধুনিক সাহিত্যিকদের মধ্যে একটা দ্বিধা আছে, যাকে আমরা শেকড়চ্যুতি বলি।
এই কবির কবিতার বিশেষ করে এই বইটির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দুইটি বা ততোধিক ঘটনার আপাত বৈশাদৃশ্যকে (বিষয়টিকে ঘটনার মেজাজ বা আবহের বৈপরীত্য হিসেবে দেখলেই ভালো) একটি কবিতায় ধারণ করা। কিন্তু তাদের বৈপরীত্য এখানে বাধা না হয়ে বরং নতুন অর্থের জন্ম দেয়। এই প্রক্রিয়ায় কোনোরূপ বাড়তি জোর নেই, স্বতস্ফুর্তভাবে ঘটে, তাই অভিনবত্ব আসে। একটি উদারহরণ দেখা যেতে পারে, তবে সম্পূর্ণ কবিতাটি না পড়লে পাঠক আমার বক্তব্যটি পুরোটা বুঝতে পারবেন না,
ছাগল খেদানি বৃষ্টি।
আকাশ উপুড় হয়ে ছাইরঙ ঝিরিঝিরি পতনোম্মুখ।
মাঠে, একটা সফেদ গাভী ঘাস ছেঁড়া শব্দ ছড়ায়।
….
একা, একজন লোক
নিজেরই ঘরে ঢুকে
কাউকে না পেয়ে—ফিরে যাচ্ছে।
(জনপদ, ঋষি ও প্রাচীন বটগাছ, ঐ)
এখানে একটা মাঠের মধ্যে বৃষ্টি, হাঁস এমন অনেককিছু উল্লেখের পরেই অপ্রত্যাশিতভাবে একজন লোকের কথা চলে এসেছে। যে নিজের ঘর থেকে ফিরে যাচ্ছে কাউকে (নাকি নিজেকে?) না পেয়ে। স্পষ্টতই দুইটি ভিন্ন মেজাজের মখোমুখি হতে হয় এখানে, কিন্তু প্রতিটিই স্বতন্ত্রভাবে একটি কবিতার মধ্যে বাঁধা পড়ে।
এসব বিষয় এই কবির জগতের, প্রবণতার ভাষিকরূপ। পৃথিবীর চূর্ণ ঘটনারাশি যেগুলোর আপাত কোনো অর্থ নেই, তিনি চূর্ণ ঘটনাগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চান কবিতায়, ফলে তার কবিতা আড়াল আবার একইসাথে স্পষ্ট দৃশ্যরূপ, একক অর্থের গণ্ডি পেরিয়ে বহুঅর্থবোধকতার দিকে যাত্রা করে। তাই তার কবিতা নতুন হয়ে ওঠে।
নাগরিক জীবন, আদিবাসী, পুরাণ, গ্রাম সবকিছু মিলিয়েই “এই গ্রাম কুড়িয়ে পেয়েছি”। সব কবিতাতেই উপরে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো কম-বেশি বর্তমান। বইটি থেকে কিছু কবিতার পঙ্ক্তি দেখা যেতে পারে,
“একটি সুন্দর লাশ, সঙ্গে আছে;—নৌকায়, জোৎস্নায়, স্বপ্নের মতো অস্পষ্ট।
(নূহ’র নৌকা, ঐ)
চন্দ্রশাসিত রাত্রি।
একটা শামুক, ধীরে, ধানগাছ বেয়ে উঠতেছে
…
নড়ছে চড়ছে ও একটা হিজলগাছ চিরকাল নিম্নভূমির
দিকে অল্প ঝুঁকে…
(ধীবর পল্লী, ঐ)
এখানে ধীবর পল্লী’র “চিরকাল” বিনয় মজুমদারের আভাস দিলেও “অল্প” শব্দটি সেটিকে নস্যাৎ করে চিত্রকল্প করে তোলে। নূহ’র নৌকা’য় “স্বপ্নের মতো অস্পষ্ট” অনেক অর্থের সম্ভাবনা যুক্ত করেছে।
আরেকটি বিষয়, রনক জামান কবিতায় স্পেস ব্যবধানে দক্ষ, তার দুইটি লাইনের মাঝে থাকা শূন্যতা তৃতীয়, চতুর্থ হয়ে ওঠে। “এই গ্রাম কুড়িয়ে পেয়েছি” বাংলা সাহিত্যে তার নিজ যোগ্যতায় স্থান অটুট রাখুক, বরং বলি বৃদ্ধি করুক, কাল’ই শেষ কথা। শেষ করি বইয়ের একটি কবিতার শেষ কয়েকটি পঙ্ক্তি দিয়ে,
শুধু
প্রশ্ন হলো
ভেতরে,
আমি
আছি
কিনা
বা,
কতটুকু আছি
(গূঢ়ৈষা, ঐ)
এই গ্রাম কুড়িয়ে পেয়েছি
লেখক : রনক জামান
প্রকাশক : বৈভব
প্রকাশকাল: ২০২৪।
মূল্য : ২৮০ টাকা।