শ্রীরামপ্রাণ গুপ্তের মোগল বংশ বইটি ইতিহাস বইয়ের তালিকায় সেই অংশে পড়ে যেগুলোকে আকরগ্রন্থ বলা হয়। কারণ এই বইগুলো থেকে শত শত বই জন্ম নেয়। যেমন কোনো ইতিহাসকার যদি ভারতের মুসলিম শাসনের ইতিহাস লিখতে যান, তবে তিনি কী মুগল শাসনের ইতিহাস এড়াতে পারবেন? মুগল শাসন ছাড়া ভারতের মুসলিম শাসনের ইতিহাস কোনোভাবেই সম্পূর্ণ হবে না। তখন শ্রীরামপ্রাণের এই বইটির কাছে তাকে যেতে হবে। কারণ মুগলদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ইতিহাস সেখানে আছে। অবশ্যই তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইতিহাসের আলাদা, আলাদ ইতিহাসের জন্য অন্য বইয়ের কাছে তাকে যেতে হবে, কোনো দেশের সামগ্রিকতা এভাবেই তৈরি হয়।
আকবরের শাসনামলে রাজা তুডরমল ছিলেন চারহাজারি সেনাপতি, তার কারণেই আকবর পারসীর পরিবর্তে হিন্দিতে বিচারকার্য পরিচালনার ব্যবস্থাগ্রহণ করেছিলেন, ব্রিটিস শাসনের সাথে একটু তুলনা করলেই ভারতের মুসলমান শাসনের পার্থক্য ধরা পড়বে এই ছোট উদাহরণটিতে, ব্রিটিশরা ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের প্রবর্তক আর মুগল তথা মুসলিম শাসন ভারতবর্ষকেই নিজেদের দেশ বানিয়ে তার সম্মৃদ্ধি আনয়নে বদ্ধপরিকর ছিল। ফলে এখানে বিরোধের কোনো সুযোগ নেই।
লেখক বইটি শুরু করেছেন চেঙ্গিস খাঁ-এর আলোচনা দিয়ে। কারণ তিনিই মোগল বংশের প্রথম শক্তিশালী প্রতিনিধি এবং পরবর্তী সবাই তার বংশধর। এরপর একে একে তার উত্তরাধীকারীগণ ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ও মুগল বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট আকবরসহ তৈমুর লঙ্গ, বাবরের পুত্র হুমায়ুন এবং অন্য উল্লেখযোগ্য সবাই যেমন, শেরশাহ, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আলমগীরের আলোচনা এসেছে। পরের দুইটি অধ্যায় হলো, “মোগলদের অধঃপতন” ও “মোগল সাম্রাজ্য”। শ্রীরামপ্রাণ গুপ্ত সামগ্রিক একটা ইতিহাস লিখতে চেয়েছেন, তাই তৈমুর লঙ্গসহ উল্লেখিত সবার বর্ণাতেই তিনি তাদের রাজ্য শাসনের সর্বদিক বিবেচনায় নিয়েছেন।
যেমন, আকবরের শাসনামলে রাজা তুডরমল ছিলেন চারহাজারি সেনাপতি, তার কারণেই আকবর পারসীর পরিবর্তে হিন্দিতে বিচারকার্য পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিস শাসনের সাথে একটু তুলনা করলেই ভারতের মুসলমান শাসনের পার্থক্য ধরা পড়বে এই ছোট উদাহরণটিতে। ব্রিটিশরা ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের প্রবর্তক আর মুগল তথা মুসলিম শাসন ভারতবর্ষকেই নিজেদের দেশ বানিয়ে তার সম্মৃদ্ধি আনয়নে বদ্ধপরিকর ছিল। ফলে এখানে দ্বিমতের কোনো সুযোগ নেই। মুসলিম শাসনের সময় বাংলা ভাষাও সম্মৃদ্ধ হয়েছে। অবশ্য আজকের হিন্দি ভাষা উপনিবেশের ইংরেজির সমতুল্য আচরণ করছে। ভারতীয় কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা বৈচিত্রে বিশ্বাসী নয় ফলে হিন্দির মাধ্যমে অন্য প্রদেশের ভাষাকে হরণ করতে উদ্যত হয়েছে। যেটা ইংরেজরাও পারেনি।
শ্রীরামপ্রাণ গুপ্তের মোগল বংশ বইয়ের শেষে পরিশিষ্ট অংশে এসেছে, আবুল ফজল, নিজাম উদ্দীন, বদায়ূনি, ফেরিস্তা, খাফি খাঁ, গোলাম হোসেন—প্রমুখদের ইতিহাস। আবুল ফজলের আকবরনামা বিখ্যাত বই, তার জন্য আলাদা অধ্যায়(সংক্ষিপ্ত) না থাকলে অপূর্ণই থাকত বইটি। বদায়ূনির বিষয়ে বলা যায়, তিনি আকবরের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন তার জ্ঞানের জন্য। লেখক জানাচ্ছেন তিনি ধর্মীয়ভাবে গোড়া ছিলেন, কিন্তু আকবরের নির্দেশে রামায়ণ, মহাভারতের দুই অধ্যায় সহ অসংখ্য বই পারসীতে অনুবাদ করেছেন।
একজন ইতিহাসবিদের কাজ পক্ষাবলম্বন না করে সামগ্রিকতা ও সত্যকে তুলে আনা। শ্রীরামপ্রাণ গুপ্তের মোগল বংশ বইটিতে তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। মুগল বংশের একটা সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন তিনি, সেইসাথে তখনকার সমাজ-রাষ্ট্রেরও বিষদ বিবরণ বাড়তি যোগ্যতা যোগ করেছে বইটিতে। মুসলিম শাসনামলে ভারতের ইতিহাস নিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই আলবেরুনীর ভারততত্ত্ব। সুলতান মাহমুদের রাজবন্দী থেকে আলবেরুনী কিভাবে ১৩ বছর ধরে সংস্কৃত ভাষা শিখেছিলেন এবং ভারতের ইতিহাসের প্রায় সবকিছুই তুলে ধরেছিলেন এবং এর ফলে যে বইটির জন্ম হয়েছিল তা ইতিহাস গ্রন্থের মধ্যে আজো বিস্ময় জাগায়। সেই বইটি নিয়ে লিখেছেন প্রেমময় দাশগুপ্ত আলবেরুনীর দেখা ভারত। মুগল বংশের সঙ্গে প্রেমময় দাশগুপ্তের অলবেরুনীর দেখা ভারত বইটির উপর আলোচনাও পড়তে পারেন।
মোগল বংশ
লেখক: শ্রীরামপ্রাণ গুপ্ত
বিষয়: ইতিহাস
প্রকাশকাল: ২০২৫
প্রকাশক: অবসর প্রকাশনা সংস্থা
মূল্য: ৪৮০ টাকা।
