বাহিরানা

অর্থনীতির ন্যায়-অন্যায় বই রিভিউ—সনৎকুমার সাহা—বাংলাদেশের অর্থনীতি পাঠে সহায়ক


সনৎকুমার সাহা বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক এবং অর্থনীতি নিয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ লেখা রয়েছে। অর্থনীতির বইগুলোর মধ্যে “ভাবনা অর্থনীতির: বিশ্বায়ন উন্নয়ন ও অন্যান্য” ও “সম্পদে-সংকটে: অর্থনীতির ইতিহাস চর্চা ও প্রয়োগ”-এর কথা বলা যায়। বিশ্বায়ন ও অর্থনীতির সংযোগ বোঝা যেকোনো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই দেশটির অর্থনীতি কোন কাঠামোতে পড়েছে ও এরসঙ্গে তার ইতিহাস না জানলে বিশ্বায়ন মোকাবেলা করা অসম্ভব। দ্বিতীয় বইটিতে বাংলাদেশের পাকিস্তান পর্বের পূর্ব থেকে বর্তমান পর্যন্ত অর্থনীতির রূপবদলের ইতিহাস পাই আমরা। ফলে, বিশ্বায়নের প্রভাব মোকাবেলার নিশানা খুঁজে পাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। সনৎকুমার সাহার “অর্থনীতির ন্যায়-অন্যায়” বইটি একটু অন্য ধরণের, এবং একটু জটিল। শুধুমাত্র যারা এই ক্ষেত্রটি নিয়ে কাজ করেন, তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সাধারণ পাঠকদেরও ন্যায়-অন্যায়ের সঙ্গে অর্থনীতির সংযু্ক্তি খুঁজে দেখতে দোষ কী। বইটিও এমনভাবে লেখা তাতে সব ধরণের পাঠকই সেখান থেকে চিন্তার রসদ খুঁজে পাবেন।

আবার ষোড়শ থেকে আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে ইউরোপের “মার্কেন্টাইলিজম” বা বানিজ্যবাদের প্রভাব প্রবল ছিল। সনৎকুমার সাহা এই মতবাদের সঙ্গে উপনিবেশবাদের গভীর সম্পর্ক আবিষ্কার করেছেন। আমদানি-রপ্তানি মূল্যের রকমফের ঘটিয়ে ইউরোপের উপনিবেশবাদী কর্তৃত্ব প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়েছিল। এই রকমফেরের জন্য প্রয়োজন উপনিবেশের বাজার নিজেদের হাতে নেওয়া, আমাদের মসলিন কাপড় বিলুপ্ত হয়েছে হয়ে গেছে, নীল চাষিদের আঙুল কাটা গেছে এই কারণেই।

আটটি প্রবন্ধ নিয়ে গড়ে উঠেছে বইটি, প্রবন্ধগুলো হলো, “অর্থনীতির তত্ত্বতালাশ” “সমাজতন্ত্র ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত” “মানব-উন্নয়ন: ঘরে ও বাইরে” “ব্যাংক-ব্যবস্থা ও ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা” “আর্থ-সামাজিক বাংলাদেশ: ভাবনা-দুর্ভাবনা” “অর্থনীতির তত্ত্বজ্ঞানী অমিয়কুমার দাশগুপ্ত” “অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের সময় এবং তারপর” “জনসংখ্যার হিসাব-নিকাশ”।

“অর্থনীতির তত্ত্বতালাশ” প্রবন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করেছেন লেখক, অর্থনীতির তত্ত্ব কীভাবে গড়ে ওঠে? মানব সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন উপাদান সেই তত্ত্বকে গড়ে তোলে? সমাজবদ্ধ মানুষের আদান-প্রদান, রাষ্ট্রকলা তত্ত্ব নির্মাণের বাস্তব ভিত্তি হলেও এগুলোই শেষ কথা নয়, তবে তত্ত্ব নির্মাণের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ী মানব বসতী এবং মানবযুথের পাস্পরিক বিনিময়ের (সেখানে সুখ-দুঃখের মতো মানবিক আবেগও জড়িত থাকবে অবশ্যই, থাকবে তাদের সংস্কৃতিও, এই কারণেই আমরা এশীয় ও ইউরোপীয় সংস্কৃতি বর্গ ব্যবহার করি) প্রকৃতি অনুযায়ী বিধি-বিধান রচিত হওয়া আবশ্যক। আসল কথা হচ্ছে, ভাবনা ও পদ্ধতির শৃঙ্খলা, লেখকের কথাই উদ্ধৃত্ত করি, “অর্থনীতিতে সবটাই তার জীবন ও জীবিকানির্ভর। কালের কক্ষপথেও তার বিচরণ। কিন্তু তত্ত্বের স্বীকৃতি পেতে—গ্রহণ বা বর্জনের নয়—ভাবনা ও পদ্ধতিতে শৃঙ্খলা অনিবার্য।”(অর্থনীতির তত্ত্বতালাশ)

এ না হলে কোনো তত্ত্বই তার ভিত্তি পায় না, আর সেটি সম্ভব হয়েছিল ইউরোপে ষোড়শ শতাব্দীতে।

আবার ষোড়শ থেকে আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে ইউরোপের “মার্কেন্টাইলিজম” বা বানিজ্যবাদের প্রভাব প্রবল ছিল। সনৎকুমার সাহা এই মতবাদের সঙ্গে উপনিবেশবাদের গভীর সম্পর্ক আবিষ্কার করেছেন। আমদানি-রপ্তানি মূল্যের রকমফের ঘটিয়ে ইউরোপের উপনিবেশবাদী কর্তৃত্ব প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়েছিল। এই রকমফেরের জন্য প্রয়োজন উপনিবেশের বাজার নিজেদের হাতে নেওয়া, আমাদের মসলিন কাপড় বিলুপ্ত হয়েছে হয়ে গেছে, নীল চাষিদের আঙুল কাটা গেছে এই কারণেই। কারণ মসলিনকে বিলেতের ফ্যাক্টরিতে তৈরি করা সম্ভব নয়, অপরদিকে তাদের ফ্যাক্টরি যন্ত্রের সাহায্যে প্রচুর কাপড় উৎপাদন করে। তাই বেশি দামে সেই কাপড় বিক্রি করার জন্য, প্রতিদ্বন্দ্বী পন্যকে হঠিয়ে দেওয়াই তাদের কাছে যুক্তিযুক্ত ছিল। এই পদ্ধতিটি পুঁজিবাদে আজও বেশ কার্যকর। অবশ্য পরোক্ষ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় এই যা।
অর্থনীতির দুইটি বা ততোধিক তত্ত্বের দ্বন্দ্ব চলে উপরোক্ত মানুষের জীবন-জীবীকার জন্যেই। লেখক কার্ল মার্ক্সের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের আশ্রয় নিয়েছেন এই দ্বন্দ্ব চিহ্নিতকরণে, পাঠে এটা বোঝা যায়।

সনৎকুমার সাহার অর্থনীতির ন্যায় অন্যায় বইয়ে “আর্থ-সামাজিক বাংলাদেশ: ভাবনা-দুর্ভাবনা” প্রবন্ধটিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্বল জায়গুলো চিহ্নিত ও ভবিষ্যতপন্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটি “মানব-উন্নয়ন: ঘরে ও বাইরে” শিরোনামের প্রবন্ধটির সাথে যোগ রেখে পড়লে ভালো হবে। অন্যদিকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার হালচাল নিয়ে লেখাটিও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এই ক্ষেত্রটিকে অবহেলা করা কোনোভাবেই উচিত নয়। জনসংখ্যার হিসেব-নিকেশও প্রয়োজনীয়, কারণ জনগণ অর্থনীতির কারক, এ নিয়ে প্রবন্ধটিও তাই বিশেষ। অর্থনীতিবিদ অমিয়কুমার দাশগুপ্তকে অনেকেই উন্নয়নমূলক অর্থনীতির প্রথপ্রদর্শক হিসেবে মানেন, বর্তমান বইটিতে তাকে নিয়ে গভীর ও বিশদ আলোচনা করেছেন লেখক।

এখানে দেখা যাচ্ছে অর্থনীতির ন্যায়-অন্যায় নিয়ে আলাদা কোনো প্রবন্ধ নেই। না থাকারই কথা বা না থাকার সিদ্ধান্তই উত্তম, কেননা অর্থনীতি মানুষের সমাজবদ্ধতা, রাষ্ট্র ও সামগ্রিক বিনিময়ের সঙ্গে জড়িত। ফলে এই ন্যায় ও অন্যায়কে ইতিহাসের কালপরিক্রমায় দেখতে হবে, মানুষের কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতেই এর ভিত্তি। সনৎকুমার সাহা তা-ই করেছেন, সমাজ ও রাষ্ট্র ও মানুষের জীবনের অর্থনীতির আলোচনা করে এর ন্যায় ও অন্যায়কে বের করে আনতে চেয়েছেন।

অর্থনীতির ন্যায়-অন্যায়
লেখক : সনৎকুমার সাহা
বিষয় : অর্থনীতি, প্রবন্ধ
প্রকাশকাল : ২০২৪
প্রকাশক : কথাপ্রকাশ
দাম : ৪০০ টাকা।

বইটি কিনতে চাইলে:

অর্থনীতির ন্যায়-অন্যায় (Orthonitir Nay-Onnay) – বাহিরানা


Leave a Comment