দিপু চন্দ্র দেব
মামুন হুসাইনের উপন্যাস “নিক্রপলিস” ছিল বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তার গদ্যের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, চরিত্র বা ঘটনার ভেতর প্রবেশ করে তিনি তার সামগ্রিকতা বের করে আনতে চান। অবশ্য বর্ণনার অতিভার ফেলেই সেটা ঘটে। এর কারণ বলা যায় লেখকের সুক্ষ্ণ বিশ্লেষণপ্রবণতা। ফলে তার গদ্য একটি নিজস্ব মাত্রা ও ভঙ্গি অর্জন করেছে, যা আলাদা। মামুন হুসাইনের উপন্যাস “স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ” একজন সাহিত্যিকের অন্তর্মানস ও পরিপার্শ্বের ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে। মাত্র ৭০ পৃষ্ঠার বইটিকে উপন্যাসিকা বললেও চলে, কিন্তু পৃষ্ঠাসংখ্যা দিয়ে তো সাহিত্যের বিভাগ হয় না, যা উপন্যাস তার ভেতর উপন্যাসের গুণগুলো থাকতে হয়। সেই হিসেবে একে উপন্যাস বলতে পারি, অবশ্যই আমাদের পাঠ-অভিজ্ঞতা সেখানে অনুঘটকের ভূমিকা নেবে।
এই আখ্যানটিকে খুব সহজেই আত্মজৈবনিক বলা যায়, কারণ সেখানে ব্যক্তি মামুন হুসাইন বা তার অভিজ্ঞতাকে দেখা যায়। আর তাজমহল রোডের ইচ্ছামৃত্যু বেছে নেওয়া রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীটিকে আমরা অনায়াসেই “সাদী মহম্মদ” বলে শনাক্ত করতে পারি। এভাবে বলা যায়, বাস্তবের চরিত্ররা তার নিপুণ গদ্যে শিল্পের রূপ নিয়েছে, তার বহমান স্মৃতিবিস্মৃতির জীবনও।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, সভ্যতা যে ক্রমাগত আমাদের একা করে ফেলছে, তারই প্রতীক। তার মানসজগতে ভিক্টোরিয়ান ঘরানার রবীন্দ্রনাথ আধিপত্য বিস্তার করেন কিন্তু তাকে বাস করতে হয় জীবননান্দের ধূসর জগতে। মানে বৈপরীত্যের আধুনিক সময়ে। ফলে কোনোভাবেই বর্তমানের খেই ধরতে পারে না সে। উপন্যাসটি তার মনোলগের মাধ্যমে শুরু হয়, চুম্বকের মতো টানটান ভাষার মধ্য দিয়ে আমরা তার মনে গহনে উঁকি দিই। দেখতে পাই, সেখানে গাজা যুদ্ধের অভিঘাত, আর এক শিল্পীর আত্মহত্যার ঘটনার বিবরণ। আরো অসংখ্য ঘটনা জড়িয়ে-পেঁচিয়ে আছে, তার নিজের অভিজ্ঞতার সাথে তার কাছে বলা অন্যদের অভিজ্ঞতাও তার নিজের হয়ে যায়, জীবন যে স্বপ্নের মধ্যে ঘটা ঘটনা নয়, তা অমরা জোর দিয়ে অস্বীকার করি কীভাবে? প্রায়শই অন্যরাও তো আমরা হয়ে যাই অনুভবের জোরে। এরই প্রমাণ মেলে তার যাপিত জীবনে।
এই আখ্যানটিকে খুব সহজেই আত্মজৈবনিক বলা যায়, কারণ সেখানে ব্যক্তি মামুন হুসাইন বা তার অভিজ্ঞতাকে দেখা যায়। আর তাজমহল রোডের ইচ্ছামৃত্যু বেছে নেওয়া রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীটিকে আমরা অনায়াসেই “সাদী মহম্মদ” বলে শনাক্ত করতে পারি। এভাবে বলা যায়, বাস্তবের চরিত্ররা তার নিপুণ গদ্যে শিল্পের রূপ নিয়েছে, তার বহমান স্মৃতিবিস্মৃতির জীবনও। আর উপন্যাসটিতে ঘুরে ফিরেই আত্মহত্যার বিষয়টি আসে, বইয়ের নামের সাথে মিল রেখে। পরিত্রাণ বাঁচায় নাকি নির্বাণে নাকি ইচ্ছামৃত্যুতে, এরকম সব লুক্কায়িত গভীর-গহন প্রশ্নের ভেতর উত্তরগুলোও অনুত্তর হয়ে থাকে। আর এতেই বইটি ভিন্নমাত্রা অর্জন করে।
মামুন হুসাইনের উপন্যাস স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ-এ স্বেচ্ছামৃত্যু, নিঃসঙ্গতা, দেশীয় আবহের সাথে সাথে বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ এসেছে প্রবলভাবে, ব্যক্তির অক্ষমতার দূরবীন দিয়ে দূদ্ধ ও দুর্ভিক্ষকে দেখিয়েছেন মামুন হুসাইন, বই থেকে কয়েকটি বাক্য দেখা যেতে পারে,
“যুদ্ধের আতশবাজি হয় খেলা অথবা অতীব তরল ঘটনা—সাঁজোয়া বাহিনীর সাজসজ্জা এড়িয়ে আমরা আইরিশ কফি এবং রেড আই কফির তফাৎ শিখি; অথবা ইজরায়েলি দূতাবাসের সামনে ইউএন এয়ারফোর্সের অ্যারন বুসনেলের স্বেচ্ছাদাহ দেখতে-দেখতে আর্তচিৎকার শুনি—ফ্রি প্যালেস্টাইন।”
এখানে তার গদ্যের গুণে ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মাপা শব্দে, নির্মেদ বাক্যে তিনি একটি কবিতার চিত্রকল্প ফুটিয়ে তুলেছেন। যেখানে উপন্যাসটি ও আমাদের জীবনের ভেদরেখা মুছে যায়। ব্যক্তি অসহায় কিন্তু জীবন সে চলমান। কিন্তু উদ্ধার কোথায়? এর পথ বাতলে দেওয়ার দায় ঔপন্যাসিকের নয়, তার দায় দেখানোর, যা ঘটছে শিল্পের মধ্যে তার বয়ান নির্মাণ করাই তার মোক্ষ।
বইয়ের ভেতরকার গল্পটি আকর্ষণ করে বিশেষ করে তার ভেতরে থাকা বহমান প্রচ্ছন্ন একাকীত্ববোধের কারণে। এর ভাষা কাব্যধর্মী কিন্তু মেদহীন গদ্যের সকল রূপরসযুক্ত। তাই এটি সংক্রামকের গুণ পেয়েছে ভেতর, বাহিরে। উপন্যাসটির বাংলাসাহিত্যে চিরস্থায়ী হওয়ার গুণ খুব ভালোভাবে রয়েছে। পাঠকদের আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি শিল্পের দায়ও যেহেতু রয়েছে। সব উপন্যাস সেই দায়ের ওজন বহন করে নিজের উত্তরণ ঘটাতে পারে না, মামুন হুসাইন পেরেছেন বললে বেশি বলা হয় না।
স্বরচিত আত্মার পরিত্রাণ
লেখক : মামুন হুসাইন
বিষয় : উপন্যাস
প্রকাশকাল : ২০২৫
প্রকাশক : কথাপ্রকাশ
দাম : ২০০ টাকা।