দিপু চন্দ্র দেব
পৃথিবীতে যদি দেশভাগ ও ধর্মীয় দাঙ্গার একটি মাত্র গল্পও কখনও লেখা হয় যেখানে নশৃংশতা চিত্র দগদগ করে জ্বলছে—তাহরে সেই গল্পটি “পেশাওয়ার এক্সপ্রেস”। জ্যোতির্ময় নন্দী বাংলায় অনুবাদ করেছেন কৃষণ চন্দরের “পেশাওয়ার এক্সপ্রেস ও অন্যান্য গল্প” বইটি।
সভ্যতাটির অতীত ও বর্তমান এই বাক্যগুলোতে কী অবলীলায় ধরা পড়ে গেছে। এ তো গেল মুসলমান অঞ্চল দিয়ে হিন্দুদের ভারত যাওয়ার নৃশংস বর্ণনা, বিপরীত দিক থেকে যে মুসলমানরা পাকিস্তান যাচ্ছিল তাদের সাথে কী হচ্ছিল? এই পেশাওয়ার এক্সপ্রেস সেই কথাও জানায় আমাদের। যে, কোনো তারতম্য নেই, হিন্দুদের সাথে যা হচ্ছিল, যারা পাকিস্তান যাচ্ছিল তাদের সাথেও একই ঘটনাই ঘটছিল।
সুবোধ ঘোষের গল্প “অযান্ত্রিক” এর বুড়ো ফোর্ড গাড়ির কথা মনে পড়ে, যে গল্প নিয়ে ঋত্বিক কুমার ঘটক একই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। বিমল এই গাড়ির সাথে বছরের পর বছর থাকতে থাকতে তাকে প্রাণবান সত্তা হিসেবে ধরে নেয়। বিমলের মনে হয় সে গাড়িটির সাথে কথা বলতে পারে, সে তার সব কথার উত্তর দেয়, শুনে। এরকমই প্রাণবান রেলগাড়ির গল্প পেশোয়ার এক্সপ্রেস, যে দেশভাগ ও হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় দাঙ্গার কবলে পড়া এলাকা দিয়ে যাওয়ার জন্য পাকিস্তান থেকে হিন্দু যাত্রীদের তার মধ্যে চড়ে ভারতে যাওয়ার গল্প শোনায় আমাদের। একটা অংশ দেখা যেতে পারে,
“পেশাওয়ার স্টেশনে পাহারা ছিল জবরদস্ত এবং সেনাবাহিনীর জওয়ানরা কাজ করছিল খুব চৌকসভাবে। আমি পাঞ্জাবের রোমান্টিক ভূমির উদ্দেশ্যে কদম না বাড়ানো পর্যন্ত এসব লোক, যাদেরকে পাকিস্তানে বলে পনাহগুঞ্জি (আশ্রয়াপ্রার্থী) আর ভারতে বলে শরণার্থী, তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারল না।” এর একটু পরেই আমরা দেখি, পথে কী ঘটে,
“ওদের কথা ভিত্তিতে বেলুচ সিপাইরা প্রত্যেক বগি থেকে কিছু কিছু মানুষ বের করে নিয়ে ওদের হাসে তুলে দিল। পুরো দুইশ মানুষ বের করে নেওয়া হলো। একটা কমও নয়, একটা বেশিও নয়।”
এই যাত্রীদের সাথে কী হয়েছিল? কৃষণ চন্দর আশ্চর্য প্রকাভঙ্গীতে তক্ষশীলার বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে আমাদেরকে তা জানান,
“এখানে এশিয়ার সবচে বড় ইউনিভার্সিটি ছিল আর লাখ লাখ শিক্ষার্থী এই সভ্যতা-সংস্কৃতির আলয়ে নানান বিদ্যা শিখত।
আরও পঞ্চাশজন মারা পড়ল।”
“তক্ষশীলার আশ্চর্য ভবনে কত সুন্দর সব মূর্তি ছিল, পাথরে খোদিত সৌন্দর্যের কত অমূল্য নমুনা, সুপ্রাচীন সংস্কৃতির ঝলমলে কত প্রদীপ।
আরও পঞ্চাশজনকে মেরে ফেলা হলো।”
(অনুবাদ, জ্যোতির্ময় নন্দী)
সভ্যতাটির অতীত ও বর্তমান এই বাক্যগুলোতে কী অবলীলায় ধরা পড়ে গেছে। এ তো গেল মুসলমান অঞ্চল দিয়ে হিন্দুদের ভারত যাওয়ার নৃশংস বর্ণনা, বিপরীত দিক থেকে যে মুসলমানরা পাকিস্তান যাচ্ছিল তাদের সাথে কী হচ্ছিল? এই পেশাওয়ার এক্সপ্রেস সেই কথাও জানায় আমাদের। যে, কোনো তারতম্য নেই, হিন্দুদের সাথে যা হচ্ছিল, যারা পাকিস্তান যাচ্ছিল তাদের সাথেও একই ঘটনাই ঘটছিল। অথচ দুইপক্ষের সাথেই এরকম হওয়ার কী কথা ছিল? সেই প্রশ্নের দায় আমাদের উপর। আমাদেরকেই এর উত্তর খুঁজে বার করতে হবে।
এই গল্পটিতেই শেষ নয় জ্যোতির্ময় নন্দী আরো কয়েকটি গল্পের অনুবাদ করেছেন কৃষণ চন্দরের পেশাওয়ার এক্সপ্রেস ও অন্যান্য গল্প বইটিতে, গল্পগুলো হলো, “অমৃতসর স্বাধীনতার আগে” “অমৃতসর স্বাধীনতার পর” “এক বাইজির চিঠি” “আধঘন্টার খোদা” “ইরানি পোলাও” “জামগাছ” ও একটি বড় গল্প “অন্নদাতা”।
যেমন, “অমৃতসর স্বাধীনতার আগে” গল্পটিতে পাকিস্তান গঠনের ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন কৃষাণ চন্দর। সিদ্দিক ও ওম প্রকাশ নামের দুই বন্ধু, দেশভাগের কারণে ঘটা সংঘাতের মধ্যে একে অন্যের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে—তার গল্প অমৃতস্বর স্বাধীনতার আগে। দেশভাগের চড়ামূল্যের কথা জানতে পারি আমরা এই দুই বন্ধুর মাধ্যমে।
বইটির বেশিরভাগ গল্পেই দেশভাগের নির্মম ঘটনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কৃষাণ চন্দরের সাহিত্যকে বাংলায় আরো ভালোভাবে গ্রথিত করতে জ্যোতির্ময় নন্দীর অনুবাদে “পেশোয়ার এক্সপ্রেস ও অন্যান্য গল্প” বইটি ভূমিকা রাখবে।
পেশাওয়ার এক্সপ্রেস ও অন্যান্য গল্প
লেখক : কৃষণ চন্দর
অনুবাদ : জ্যোতির্ময় নন্দী
বিষয় : অনুবাদ গল্প
প্রকাশকাল : ২০২৫
প্রকাশক : বাতিঘর
দাম : ৪০০ টাকা।