স্কটিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও শল্যচিকিৎসক ফ্রান্সিস বুকানন (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৭৬২-১৫ জুন ১৮২৯) দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা (চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী) ভ্রমণ করেছিলেন, সেই ভ্রমণবৃত্তান্ত তিনি লিখেও রেখেছিলেন। বুকাননের মূল পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করেছেন ভেলাম ভান সেন্দেল। ভেলাম ভান সেন্দেলের দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকানন (১৭৯৮) বইটি এমন এক ইতিহাস আমাদের সামনে আনে, যাকে অভূতপূর্ব বলা যায়। তার পুরো নাম ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিলটন। ব্রিটিশ বাণিজ্যবোর্ড থেকে তাকে চট্টগ্রাম ও টিপেরা ভ্রমণে পাঠানো হয়েছিল মসলা চাষের সফলতার বিষয়ে জানতে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সম্মৃদ্ধ ভূ্প্রকৃতির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গও এসেছে বইটিতে।
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকানন বইটির আরেকটি বিশেষত্ব হলো পার্বত্য অঞ্চলের বিবরণ। ইংরেজ সাম্রাজ্যে অন্তর্ভূক্ত হবার আগের পার্বত্য অঞ্চলের এটিকেই প্রথম সুসংবদ্ধ বিবরণ ধরা হয়। মারমা সর্দার কাউং-হ্লা-প্রুর সাথেও তিনি আলাপ করেছেন, তার বিবরণী রয়েছে বইয়ে। এর সঙ্গে গভীর দৃষ্টিতে অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠির জীবনও দেখেছেন তিনি যেমন তার কাছ থেকে, চাকমা, ম্রো, যো, টিপরাদের জীবনপদ্ধতি ও সামাজের কথা পাই আমরা। এছাড়াও বৃহত্তর চট্টগ্রামের ধর্মবিশ্বাস, গৃহনির্মাণ থেকে দাসপ্রথা (ঋণের জন্য দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল তখন), অলংকার, বিবাহপ্রথা, যুদ্ধকৌশল—সবই লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি।
বইটি মূলত ইতিহাসের, এ নিয়ে সেন্দেল ভূমিকা অংশে যা জানাচ্ছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশ বর্তমানে বিভিন্ন উত্থান পতনের পর উন্নত বিশ্বের দান খয়রাতের উপরেই বেশি নির্ভরশীল। এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় অসহায় সমাজ ও অদক্ষ জনশক্তিকে। কিন্তু এই ধারণাটি সর্বাংশে সত্য নয়, কিন্তু প্রশ্ন হলো ধারণাটি এলো কোথা থেকে? সেন্দেল বলছেন, এর একটি কারণ আমাদের ইতিহাস চর্চার অভাব এবং ইতিহাস গবেষণায় ব্যয় করাকে অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করা। এর সূত্র সন্ধানে তিনি আরো গভীরে ঔপনিবেশিক আমলে ফিরে গেছেন, তিনি দেখতে পেয়েছে ধারণাটির মূলে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসবিদেরা।
ঔপনিবেশিক কর্তাব্যক্তিরা তাদের ঔপনিবেশিক অঞ্চলকে শোষণ করার জন্যই মূলত সেই অঞ্চলের মানুষকে অদক্ষ, ইতিহাসহীন হিসেবে মূল্যায়ন করত এবং তা প্রমাণ করার চেষ্টা করত। এই ইতিহাসবিদেরা তাদের কর্মযজ্ঞেরই অংশ। ভারতবর্ষ এবং বাংলাতেও ইংরেজরা একই কাজ করেছে। ভেলাম ভান সেন্দেলের নিজের লেখা বাংলাদেশ জনপদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বইয়েও এই কথাগুলো (যেমন, বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসচর্চা, উপনিবেশ, পূর্বপাকিস্তান, মুক্তিযুদ্ধ) পাওয়া যায় বিস্তৃতভাবে।
এই সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসবিদ ও কর্মকর্তাদের বিষয়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকও তার পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া বইয়ে সেন্দেলের মতো একই মনোভাব পোষণ করেছেন। ফলে আমাদের এখানে (এবং ভারতেও তা দেখা যায়) বর্তমানে দুইটি ধারণা একইসাথে বলবৎ আছে, একশ্রেণী ইংরেজদের মতো অদক্ষতা ও অসহায়ত্বের কথা ছড়ায়, এর বিপরীতে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদরা ছড়ায় প্রাচীন কালের স্বর্ণযুগের ধারণা। আদতে দুইটিই চরমবিন্দুতে অবস্থান করছে। এগুলোর কোনোটিতেই বৈজ্ঞানিক ইতিহাস গবেষণা নেই। এর থেকে বেরোনো প্রয়োজন আমাদের, আর তার জন্যেই ইতিহাসের প্রকৃত বইগুলো পড়া প্রয়োজন।
আর সেইসূত্রে আরেকটি বইয়ের নাম নিতে হয়, বইটি হলো ১৯১৬ সালে প্রকাশিত এফ্, সি, ডালি, আই, ই-এর বাঙ্গালাদেশে যে সকল দুর্ব্বৃত্ত জাতি। এই গুরুত্বপূর্ণ বইটিতে ডালি সেন্দেল ও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসবিদ বিষয়ক মতকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করে বাংলা অঞ্চলের কিছু গোত্রের মানুষকে কৌশলে অপরাধী জাতি হিসেবে বর্ণনা করেন। তবে, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এটাও মানতেন যে, সবাই সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসের ধারক-বাহক নয়, অনেকেই তখনকার ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস জানত ও মানত। ফ্রান্সিস বুকাননের বইটি পড়তে পড়তে আমাদের ধারণা হয় তিনিও তাদের একজন।
বুকাননের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৭৯৮ সালের মার্চ মাসে। ভেলাম ভান সেন্দেলের দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকানন (১৭৯৮) বইটি থেকে আমরা জানতে পারি, তার সেই যাত্রায় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার কৃষির, ভূপ্রকৃতি ও সামাজচিত্রের সুসংহত ও প্রণালীবদ্ধ বিবরণ খুব দারুণভাবে উঠে এসেছে। সেইসাথে পার্বত্য নৃগোষ্ঠীসমূহের প্রাঞ্জল বর্ণনাও দিয়েছেন তিনি। নদ-নদী, জলাধারসমূহের বর্ণনা দিতেও ভুলেনি। কৃষির কথা বলতে গিয়ে তিনি জুম চাষের কথা যেমন বলেছেন তেমনি নোয়াখালির লবণচাষের কথা বলতেও ভুলেননি। মানুষের জীবনযাপনের কথাও বেশ সহানুভূতির সাথে বলেছেন তিনি। আর একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসেবে উদ্ভিদের কথা তো থাকবেই, তাও আছে। এখানে বলা ভালো তার যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল শুধু মসলা চাষের সফলতার অনুসন্ধানে, কিন্তু তার ভ্রমণবৃত্তান্ত এরচেয়েও বেশি বলেই এর ঐতিহাহিসক মূল্য এত বেশি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস বই হয়ে উঠেছে। বইটিতে এসেছে কুমিল্লার ময়নামতির বৌদ্ধবিহারসহ সীতাকুণ্ডের “জলন্ত পাথর”রের বিবিরণও।
ইতিহাসের কী পুনরাবৃত্তি হয়? কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন হয়, প্রথমবার ট্র্যাজেডি আকারে দ্বিতীয়বার হাস্যরসোদ্দীপক ঘটনার আকারে। এর একটা উদাহরণ বুকানের ভ্রমণ বৃত্তান্তে পাওয়া যায়, বর্তমানে রোহিঙ্গারা বার্মিজ আর্মিদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে অবস্থান নিয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে একই ঘটনা পূর্বেও ঘটেছিল। বুকানের কাছ থেকে ১৭৮৫ সালেও রোহিঙ্গারা যে বার্মিজদের অত্যাচারে বাংলায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল তার বাস্তব বর্ণনা পাই আমরা। তাদের মানবেতর জীবনযাপনের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি বইটিতে। এই দুইবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে আমরা ট্রাজেডি কিংবা হাস্যরসোদ্দীপক বলতে পারব কী না তা জানি না। তবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান যে বহুদূর সেটা বোঝা অসম্ভব নয়, অন্তত বুকাননের কাছ থেকে জানার পর।
ভেলাম ভান সেন্দেলের দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকানন (১৭৯৮) বইটির আরেকটি বিশেষত্ব হলো পার্বত্য অঞ্চলের বিবরণ। ইংরেজ সাম্রাজ্যে অন্তর্ভূক্ত হবার আগের পার্বত্য অঞ্চলের এটিকেই প্রথম সুসংবদ্ধ বিবরণ ধরা হয়। মারমা সর্দার কাউং-হ্লা-প্রুর সাথেও তিনি আলাপ করেছেন, তার বিবরণী রয়েছে বইয়ে। এর সঙ্গে গভীর দৃষ্টিতে অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠির জীবনও দেখেছেন তিনি যেমন তার কাছ থেকে, চাকমা, ম্রো, যো, টিপরাদের জীবনপদ্ধতি ও সামাজের কথা পাই আমরা। এছাড়াও বৃহত্তর চট্টগ্রামের ধর্মবিশ্বাস, গৃহনির্মাণ থেকে দাসপ্রথা (ঋণের জন্য দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল তখন), অলংকার, বিবাহপ্রথা, যুদ্ধকৌশল—সবই লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। এর সঙ্গে ১৭৯৮ সালের ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্র ও কিছু চিত্রকর্মও রয়েছে বইটিতে। বইটির অসাধারণ বাংলা অনুবাদ করেছেন স্বাক্ষর শতাব্দ ও সম্পাদনা করেছেন প্রত্যাশা প্রাচুর্য। ব্রিটিশ আমলের দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাকে জানতে ভেলাম ভান সেন্দেলের সম্পাদনায় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকানন (১৭৯৮) বইটির বিকল্প নেই। ইতিহাস বইয়ের প্রতি আগ্রহ থাকলে ভালো পাঠক হওয়ার ৬টি উপায় নিয়ে আর্টিক্যালটি পড়তে পারেন।
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকানন (১৭৯৮)
লেখক: ফ্রান্সিস বুকানন
সম্পাদনা: ভেলাম ভান সেন্দাল
বাংলা অনুবাদ ও সম্পাদনা: স্বাক্ষর শতাব্দ, প্রত্যাশা প্রাচুর্য
বিষয়: ভ্রমণ, ইতিহাস
প্রকাশকাল : ২০২৪
প্রকাশক: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড(ইউ পি এল)
দাম: ৫৪০ টাকা।
Francis Buchanan in Southeast Bengal (1798) বইটি কিনতে চাইলে
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকানন (১৭৯৮) বাংলা অনুবাদ বইটি কিনতে চাইলে
