বাহিরানা

হিউম্যান অ্যাক্টস বই রিভিউ—হান কাং—মানুষের অজেয় স্বাধীনতার আখ্যান


দিপু চন্দ্র দেব

হান কাংয়ের “হিউম্যান অ্যাক্টস” উপন্যাসটি যেন ২০২৪ সালের বাংলাদেশের জুলাই গনঅভ্যুত্থানেরই প্রতিচ্ছবি। উপন্যাসটি যেন আমাদের জানায় পৃথিবীর সব মানুষই মূলগতভাবে স্বাধীনতাকামী। হান কাং সদ্যই নোবেল পেয়েছেন তাও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী সাহিত্যিক তিনি। তার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রভব রয়েছে আমাদের আলোচ্য বইটিতে।

বৃষ্টি একইসাথে ভয়ের কিন্তু সাম্যেরও প্রতীক। শহীদ কাদরীর বৃষ্টি নিয়ে একটি কবিতা আছে, যেখানে বৃষ্টির তোড়ে সবকিছু ভেসে যাচ্ছে। তা-ই যেন হাং কাং তার উপন্যাসে নিয়ে এলেন, কিন্তু এখানে বৃষ্টিতে ভয়, ভবিষ্যতের ভয়। যে ভয় তাড়িয়ে মানুষ গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনবে। তারই ইঙ্গিত রয়েছে এখানে।

উপন্যাসের সময় শুরু হয় ১৯৮০ সালে আর ঘটনাস্থল একসময় গিয়ে পৌঁছায় কোরিয়ার গাওয়াংজু শহরে। পার্ক চুং-হি যিনি দেশটির সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসক ছিলেন তিনি খুন হলেন তারই নিরাপত্তা সংস্থার পরিচালকের হাতে। তার হাতে কোরিয়া শীর্ষ শিল্পোন্নত দেশের তালিকায় এগিয়ে গেলেও তারা কী আদতে সুখী ছিল? এই প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয় একসময় কেননা দীর্ঘকাল যাবত দেশের জনগণ গণতন্ত্রের বাইরে ছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জনগণের অংশীদারিত্ব ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। পার্ক চুং-হির মৃত্যুর পর তাদের গভীরতর আশা ছিল গণতন্ত্র ফিরে আসার। কিন্তু সেই আশা গুড়িয়ে দিয়ে তার স্থালাভিসিক্ত হলো আরেক সামরিক শাসক চু দু-হওয়ান। কেন পর পর দুইবার সামরিক শাসনের যাতাকলে পড়ল তারা? এর কারণ লুকিয়ে ছিল তাদের সংবিধানেই। একদিন গাওয়াংজু শহরে গনতন্ত্রের জন্য রাস্তায় নেমে এলো প্রথমে ছাত্ররা। এরপর তাদের সাথে সাথে জনগণ। এরসাথে কী বাংলাদেশে ২০২৪এর জুলাইয়ের সংযোগ লক্ষ্য করা যায়?
অগুণিত হত্যা সংগঠিত হলো, মায়েরা আর্তচিৎকারে সন্তানদের লাশ খুঁজতে লাগলো, কেউ পেল, কেউ পেল না। বিষণ্ণতা আর বারুদের ধোয়া আর এর ফলে জনতার বিদ্রোহে, আত্মত্যাগে কোরিয়ার সংবিধান পরিবর্তন হলো ১৯৮৭-এর অভ্যুত্থানে। ফিরে এলো গণতন্ত্র গাওয়াংজুর ছাত্রজনতার রক্তের বিনিমিয়ে।

এর অসাধারণ কাব্যিক রূপ দিলেন হাংকাং “হিউম্যান অ্যাক্টস” উপন্যাসে। কিন্তু উপন্যাসের নাম হিউম্যান অ্যাক্টস কেন? কারণ মানুষ পৃথিবীর সর্বত্রই এক। তারা পরাধীনতা পছন্দ করে না। তারা মানবিক এক পৃথিবী চায়, যেখানে মানুষে মানুষে গড়ে উঠবে প্রাণের মিতালি। কিন্তু তার পথ সবখানেই রুদ্ধ করা হচ্ছে। তবে প্রতিরোধও গড়ে উঠছে সবখানেই। যদিও আগ্নেয়গিরির সুপ্ত লাভার মতো তা সবসময় দেখা যায় না। কিন্তু একসময় তা জ্বলে উঠে আর ছারখার করে দেয় স্বৈরসাশকের আসন।
উপন্যাসটির শুরু হয় বৃষ্টি দিয়ে, অতলভেদী কাব্যিক বর্ণনায় যা হাং কাং-এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। অরূপ ঘোষের অসাধারণ অনুবাদে যার রূপ বাংলাতেও দৃশ্যমান হয়,

“বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে,” বিড়বিড় করলে তুমি।
জোরে বৃষ্টি নামলে আমরা কী করব?”

(হিউম্যান অ্যাক্টস)

বৃষ্টি একইসাথে ভয়ের কিন্তু সাম্যেরও প্রতীক। শহীদ কাদরীর বৃষ্টি নিয়ে একটি কবিতা আছে, যেখানে বৃষ্টির তোড়ে সবকিছু ভেসে যাচ্ছে। তা-ই যেন হান কাংয়ের হিউম্যান অ্যাক্টস-এ ফিরে এলো, কিন্তু এখানে বৃষ্টিতে ভয়, ভবিষ্যতের ভয়। যে ভয় তাড়িয়ে মানুষ গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনবে। তারই ইঙ্গিত রয়েছে এখানে।

তবে এটাও বলতে হয় দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যুত্থান উত্তর কোরিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কিন্তু ভবিষ্যতের কোনো একসময় যে পারবে না তা কে বলতে পারে? বাংলাদেশের অভ্যুত্থান ইতোমধ্যেই যেহেতু বিভিন্ন দেশে তার প্রভাব রেখে চলেছে তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।

হান কাং মানবিক দৃষ্টিতে দেখেছেন ১৯৮৭-এর সময়পর্বকে এর ভুক্তভোগীর হৃদয়ের গভীরে থাকা ক্ষতের দিকে তাকিয়েছেন তিনি, এর ফলেই উপন্যাসটি বিশ্বজনীন হয়েছে। রাইফেল, কামান বারুদে মানুষকে রুখে দিতে পারে না। তবে যারা সেই সময় মৃত্যুবরণ করে তারা রেখে যায় তাদের স্বজনদের যারা সারাজীবন এই হারানোর বেদনা বয়ে বেড়ায়, এই অনিবার্য সত্যটি হাং কাং ভুলেননি।

হিউম্যান অ্যাক্টস
লেখক: হান কাং
অনুবাদ: অরূপ ঘোষ
বিষয়: অনুবাদ উপন্যাস
প্রকাশকাল : ২০২৫
প্রকাশক: প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
দাম: ৪০০ টাকা ২০% ছাড়ে ২৪০ টাকা।

বইটি কিনতে চাইলে:

হিউম্যান অ্যাক্টস (Human Acts) – Han Kang – বাহিরানা


Leave a Comment