বাহিরানা

হান কাংয়ের দ্য ভেজিটেরিয়ান: মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে অন্যরকম উপন্যাস


(সর্বশেষ আপডেট ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫)


একটা সাধারণ পরিবার যেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই খুবই সাধারণ এক জীবন যাপন করে। সেখানে হঠাতই স্ত্রীর একটি সিদ্ধান্ত অসাধারণ এক বাঁকের মুখোমুখি করে পরিবারটিকে। এতে তাদের জীবনের পরিচিত পরিসর আমূল বদলে যায়। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইয়ং-হে। ২০২৪-এ সাহিত্যে নোবেল জয়ী দক্ষিণ কোরিয়ার কথাসাহিত্যিক হান কাংয়ের দ্য ভেজিটেরিয়ান ‍উপন্যাসটি ইয়ং-হের স্বামীর এই আপাত সাধারণ কিন্তু বিস্ময়কররকম সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে শুরু হয়। এই বলে যে, “আমার স্ত্রী নিরামিষাশী হবার আগ পর্যন্ত, বরাবরই আমি তাকে অতি সাদামাটা সাধারণ একজন নারী হিসেবেই দেখে এসেছি।” চামড়াহীন বাস্তবতায় প্রবেশ যাকে বলে, এ যেন তাই। কোনো ভণিতা নেই। হান কাং উপন্যাসটিতে এরপর পরতে পরতে সমাজ ও পরিবারের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে থাকেন।

হান কাং-এর নোবেল পুরস্কার প্রদানের কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি বলেছিল, তার গদ্য কাব্যিক। নোবেল কমিটি তাদের ওয়েবসাইটে তার কারণও জানিয়েছে, হান কাং মূলত ১৯৯৩ সালে একজন কবি হিসেবেই সাহিত্যে তার যাত্রা শুরু করেছিলেন। পরে ১৯৯৫ সালে ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি কথাসাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এর সাক্ষ্যও দ্য ভেজিটেরিয়ান বইটিতে রয়েছে। তার কাব্যিক সত্তা এখানে বিস্ময়ের ডানা মেলেছে গদ্যে। দ্য ভেজিটেরিয়ান প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৭-এ, কোরিয়ান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন দেবোরা স্মিথ। এই বইয়ের জন্য হান কাং আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছিলেন ২০১৬ সালে। এই বইটি তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত। কারণ নারীদের জীবন যাপনকে পুরুষবাদী সমাজকর্তৃক নিয়ন্ত্রিত করার প্রতিবাদ হিসেবে বইটির ভূমিকা অনন্য। পাঠকেরা যদি হান কাং-এর যেকোনো একটি বই দিয়ে তাকে পাঠ করা শুরু করতে চান তাহলে এই বইটি দিয়েই করা উচিত। কেননা বইটিতে কাং-এর সাহিত্যশৈলীর অভিনবত্বের প্রায় সবকিছুই দ্য ভেজেরেরিয়ান-এ বর্তমান।

নোবেল জয়ের পর হান কাংয়ের দ্য ভেজিটেরিয়ান-এর অসংখ্য বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তবে যা হয়, বেশিরভাগই বাজার ধরার চেষ্টা। সাবাবা মোর্শেদ টুই-এর এই অনুবাদটি ব্যতিক্রম। পড়তে পড়তে মনে হয় তিনি বইটির ভেতর প্রবেশ করেছেন, আর মূলের হান-এ গীতিময়তাকে সহজ, সাধারণ কিন্তু তীর্যকভাবে বাংলায় নিয়ে এসেছেন। তবে অনেক জায়গায় শব্দের অতিব্যবহার একটু চোখে লাগে, যেমন, “তার মন জয় করার জন্য জ্ঞানের প্রদর্শন জাহির করারও তাই প্রয়োজন হয়নি।” এখানে প্রদর্শনের পর জাহির অতিরিক্ত শব্দ, এটা একটু ভিন্নভাবে অনুবাদ করা যেত। এরকম আরো কয়েক জায়গায় রয়েছে। তবে তার অনুবাদে বইটি সুখপাঠ্য হয়েছে।

দ্য ভেজেটেরিয়ান উপন্যাসটির কাহিনি এরকম, ইয়ং-হে একদিন হঠাত করেই ভেজেটেরিয়ান হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে মাংস খাওয়া বাদ দিয়ে দেয় এবং আশ্চর্যজনকভাবে সে একটি গাছ হতে চায় বলে জানায। তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ হিসেবে সে একটি দুঃস্বপ্নে কথা বলে। কিন্তু তার স্বামী বা পরিবারের কেউ তার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে না। কিন্তু সে অনড়। তার সংসার ভেঙে যেতে থাকে। তবু সে কোন অজানা ক্ষমতাবলে তার অবস্থান থেকে সরে না। নিজের জন্য কোনো লক্ষ্য স্থির করা যে কতটা শক্তি দাবী করে, আর সেই লক্ষ্যকে আকড়ে থাকার জন্য যে কী পরিমাণ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সমাজ, আপনজনদের শৃঙ্খলা একে একে উন্মোচিত হতে থাকে, হান কাং এই অসাধারণভাবে সাধারণ উপন্যাসটিতে তা আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেন।

উপন্যাসটিতে তিনটি ভাগ রয়েছে, “নিরামিষাশী” “মঙ্গোলীয় চিহ্ন” ও “জ্বলন্ত বৃক্ষেরা”। একজন অসফল শিল্পী যে আবার ইয়ং-হের ভগ্নিপতি, তার ভেতর ইয়ংয়ের প্রতি অদম্য কামনা কাজ করে। অন্যজন ইন-হে ইয়ং-হের বড় বোন। এক কসমেটিক স্টোরের ম্যানেজার। তাদের জীবনও তুলে ধরেছেন হান কাং। কাফকার মেটামরফসিস-এ জোসেফ কে’র মধ্য দিয়ে যেরকমভাবে আমরা রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের মুখোমুখি হই, হান কাংয়ের দ্য ভেজিটেরিয়ান-এও তাই। তবে ভিন্ন ও নতুন আঙ্গিকে অবশ্যই।

হান কাং-এর জন্ম ১৯৭০-এর ২৭ নভেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়াংজু শহরে। তার উপন্যাস দ্যা হোয়াইট বুক বা বাংলায় সাদা বই (২০১৬), ২০১৮ সালে আন্তার্জাতিক ম্যান বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল। উপন্যাসিটির কাহিনী এরকম, নামহীন কথক পুরো উপন্যাসজুড়ে তার ছোট বোনের মৃত্যুর কারণে তার দুঃখের কথা বর্ণনা করে। যে বোন জন্মের পর মাত্র দুই ঘন্টা বেঁচে ছিল। বইটি ভিন্ন শৈলীতে লেখা। বইয়ের নামের মধ্যে থাকা সাদা রং হচ্ছে এই নামহীন কথকের শোক, ক্ষতি, বেদনা আর মানুষের ভঙ্গুর প্রেরণার প্রতীক। বইটিকে আত্মজৈবনিক ঘরানার মনে করা হয়। দ্য ভেজিটেরিয়ান এবং দ্য হোয়াইট বুক (সাদা বই) এই উপন্যাস দুইটির মধ্যে বিষয় ও আঙ্গিকগতভাবে যতই অমিল থাকুক একটি বিষয় আমরা দুটিতেই খুঁজে পাই, তা হলো ট্রমা, কোনো হঠাৎ আঘাত বা একটি দেশের ঐতিহাসিক আঘাতের ধারাবাহিকতা ব্যক্তিকেও কীরকম আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে তার নজির রয়েছে উপন্যাস ‍দুটিতে।

এই ঐতিহাসিক ট্রমার চিত্র আমরা দেখতে পাই তার হিউম্যান অ্যাক্টস উপন্যাসে সবচেয়ে প্রবলভাবে। কোরিয়ায় ১৯৮৭ সালের অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সামরিক শাসক চু দু-হওয়ান এর পতনকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি আবর্তিত হয়। এই অভ্যুত্থানে অসংখ্য ছাত্র, সাধারণ মানুষ মারা যায়। এই বইয়ের ঐতিহাসিক ট্রমা যেন স্ফটিকস্বচ্ছ রূপ নিয়ে পাঠকদেরও ঘিরে ফেলে। তার সমগ্র সাহিত্যজুড়েই তিনি ট্রমা বা আঘাতকে কাব্যিক রূপক আর প্রতীকের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এখানেই তিনি বিশেষ আর তার গদ্যশৈলীর ভিন্নধর্মী ও কাব্যিক হওয়ার কারণ।

সোরেন কিয়ের্কেগার্ড বেদনা থেকেই সুন্দর কবিতার জন্ম হয় বলে জানিয়েছিলেন আমাদের। আর সেই কবির পাঠকেরা কবিতার সুন্দরের বন্দনায় পঞ্চমুখ হলেও কবির মুখে তারা সেই বেদনাকে দেখতে পায় না। হান কাং-এর হাস্যোজ্জ্বল চেহারাতেও তিনি একজন কবির মতো ক্ষতকে খুবই দক্ষতার সঙ্গে লুকিয়ে রাখেন, আর সুন্দর দিয়ে ঐশ্বর্যপূর্ণ করে তোলেন, তুলেছেন তার কাব্যিক কথাসাহিত্যকে।

দ্য ভেজিটেরিয়ান
লেখক: হান কাং
অনুবাদ: সাবাবা মোর্শেদ টুই
বিষয়: অনুবাদ উপন্যাস
প্রকাশকাল: ২০২৫
প্রকাশক: তরফদার প্রকাশনী
মূল্য: ৩৪০ টাকা। 

দ্য ভেজিটেরিয়ান বইটি কিনতে চাইলে


মন্তব্য করুন