দিপু চন্দ্র দেব
ইমতিয়ার শামীমের “স্তোত্রপাঠের দিন” উপন্যাসিকাটি যখন শুরু হয় তখন শুরুর টানা দীর্ঘ বাক্যে বোঝা যায় না কীভাবে কোথায় যাচ্ছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প যেমন ঘটনার পরতে পরতে উন্মোচিত হয়, উপন্যাসিকাটি অনেকটাই তেমন। তবে এর দীর্ঘ বাক্য পরম্পরায় নিরীক্ষার ছাপ আছে কিন্তু এর পেছনে থাকা লেখকের পরিশ্রমের ছাপ নেই একদম। সহজ স্বাভাবিক ও বহুস্তর এর গঠন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময কবিরা যেরকম মঞ্চে আসীন হয়ে টিএসসিতে কবিতা পড়ত, সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বর্তমানে, তারা “গ্রীলের প্রাচীরে এইদিকে লাইব্রেরি লাগোয়া মাঠটায় ঢুকে পড়েছেন।” (ঐ), এক স্বৈরশাসকের পর আরেক স্বৈরশাসকের পথ বোধহয় এভাবেই তৈরি হয়। যখন শিল্প ও সাহিত্যের পরিসর ছোট হয় তখন দেশও তার বৃহৎ পরিসর ছেড়ে ছোট হতে থাকে। এখানে এরই ইঙ্গিত দিচ্ছেন লেখক, যার ফল আমরা নিজেরাও প্রতক্ষ করেছি।
চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের আড্ডার ছলে শুরু হলেও এর ভেতর খুব কৌশলে বাংলাদেশের স্বৈরতন্ত্রের ইতিহাস ঢুকিয়ে দিয়েছেন ইমতিয়ার শামীম। খুবই রাজনৈতিক এই বইটি এরশাদের সময়কালকে ঘুরেফিরেই নিয়ে আসতে থাকে। এরশাদ বিরোধী আন্দেলনে কবি, চিত্রশিল্পীদের ভূমিকা এবং বর্তমানের অবস্থাচিত্র সবই উঠে আসে প্রসঙ্গক্রিয়ায়।
“কবিরা কবিতা পড়ে। আমরা তা শুনতে থাকি। শুনতে শুনতে বোধহয় পিপুলই বলে একসময়, এখন কী মনে হয় জানেন? কামরুল হাসান এরশাদরে ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ বলে নাই। স্টেজের উপর বইসা বইসা কবিদের এইসব আবোলতাবোল কবিতা শুনতে হবে চিন্তা কইরা ভাষণ দেওয়ার সময় আগেই বইলা দিছে দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে।” (স্তোত্রপাঠের দিন), কবিদের প্রতি অপমানসূচক এই বাক্যের সূত্রপাত হয় একদম ভিন্ন একটি কারণে, কারণটি জানলে অপমান মনে হয় না আর। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময কবিরা যেরকম মঞ্চে আসীন হয়ে টিএসসিতে কবিতা পড়ত, সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বর্তমানে, তারা “গ্রীলের প্রাচীরে এইদিকে লাইব্রেরি লাগোয়া মাঠটায় ঢুকে পড়েছেন।” (ঐ), এক স্বৈরশাসকের পর আরেক স্বৈরশাসকের পথ বোধহয় এভাবেই তৈরি হয়। যখন শিল্প ও সাহিত্যের পরিসর ছোট হয় তখন দেশও তার বৃহৎ পরিসর ছেড়ে ছোট হতে থাকে। এখানে এরই ইঙ্গিত দিচ্ছেন লেখক, যার ফল আমরা নিজেরাও প্রত্যক্ষ করেছি।
এসব মাত্র শুরু, মূল ঘটনাটি হলো শূন্য দশকের শেষ দিকে ২০০৮-২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে ফ্রান্সের মিউজিয়ামে স্কাল্পচার পাঠানোর উদ্যোদ এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় চারুকলায় যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তারই গভীর ও বহুস্তর বয়ান ইমতিয়ার শামীমের স্তোত্রপাঠের দিন বইটি। এর মধ্যেই তিনি ধারণ করেছেন স্বৈরতন্ত্রের ইতিবৃত্ত, বন্ধুত্ব, প্রেম, আড্ডা ও সম্পর্ক। সর্বোপরি একটি ঘটনা যে সবাইকে একত্রিত করতে পারে, আর সেখানে বয়স যে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না—তা-ই আমরা দেখতে পাই এখানে। এই একাত্ম হওয়ার বিষয়টি নব্বইয়ের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও ঘটেছিল। ইমতিয়ার শামীম যেন আন্দোলনের মনস্তত্বই উদঘাটন করতে চেয়েছেন।
বইয়ের গদ্য ও ঘটনার ক্রম পাঠের সময় ঘোরগ্রস্থ করে রাখে, লেখক এখানে কথাসাহিত্যে তার সার্থকতার অন্য একটি ভূমি আবিষ্কার করেছেন বলেই বোধহয়। প্রসঙ্গ ও প্রসঙ্গান্তরে একটি ঘটনাকে খতিয়ে ও ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষপটে দেখা। বইটি বিষয়ের গভীরতায় ও এর অপ্রচলিত গঠন সৌন্দর্যে পাঠকদের পাঠতৃষ্ণাকে তৃপ্ত করবে।
স্তোত্রপাঠের দিন
লেখক: ইমতিয়ার শামীম
বিষয়: উপন্যাসিকা
প্রকাশকাল: ২০২৫
প্রকাশক: গ্রন্থিক প্রকাশন
দাম: ৩৫০ টাকা।
বইটি কিনতে চাইলে:
স্তোত্রপাঠের দিন (Stutrapather Din) – বাহিরানা