বাহিরানা

মৃণাল সেন: জীবন ও সিনেমা বই রিভিউ—ফজলে রাব্বী—প্রথাভাঙা শিল্পীর প্রতিকৃতি


দিপু চন্দ্র দেব

বিশ্ব চলচ্চিত্রে বাঙালির স্বতন্ত্র আসন তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক কুমার ঘটক। তাদের সাথে আরেকজনে নাম অবশ্যম্ভাবী, তিনি মৃণাল সেন। যিনি চলচ্চিত্রের পর্দায় সমাজ ও জীবনকে এমনভাবে নিয়ে এসেছিলেন যা বাস্তবতাস্পর্শী কিন্তু রাষ্ট্র ও ব্যক্তিকে চিরে সত্যকে শিল্পের মাধ্যমে তুলে আনায় বদ্ধপরিকর। তিনি নিজস্ব শৈলি তৈরি করেছিলেন, যার মাধ্যমে তার দর্শন, আদর্শ, বোধ ও অভিজ্ঞতাকে ক্যামেরায় ভাষা দিতে পেরেছিলেন তার মতো করে। যা কালে কালে কালোত্তীর্ণের মর্যাদা পেয়েছে। ফজলে রাব্বীর “মৃণাল সেন: জীবন ও সিনেমা” জীবনীগ্রন্থটিতে এই মহৎ চলচ্চিত্রকারের জীবন ও কর্ম কালানুক্রমিকভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। মৃণাল সেন নিজেই তার আত্মজীবনী লিখেছিলেন “অলওয়েজ বিইং বর্ন” শিরোনামে। কিন্তু সেটি ইংরেজিতে লিখিত হওয়ায় অনেকের কাছেই পড়াটা কষ্টসাধ্য। নিজে লিখলেও এমন একজন মানুষের জীবনী যে আর কেউ লিখতে পারবে না এমন কোনো কথা নেই। যদি সেটিতে নতুনত্ব থাকে।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তার প্রথম চলচ্চিত্র, “বাইশে শ্রাবণ” “পদাতিক” “ভুবন সোম” “চালচিত্র”সহ উল্লেখযোগ্য, অনুল্লেখযোগ্য সব ছবির নির্মাণই এসেছে। তার প্রেম, আদর্শ, প্রতিবন্ধকতা, উত্থান—ফজলে রাব্বীর ভাষায় “কালানুক্রমিক”ভাবে উঠে এসেছে বইটিতে।

আমার বিবেচনায় ঋত্বিকে যেমন আবেগ ও মাতৃরূপের দেখা মেলে, সত্যজিৎ রায়ে যেমন শিল্পের পক্ষপাতহীনতাকে দেখা যায় এই দুজনের মাঝামাঝিতে অবস্থান করছেন মৃণাল সেন। তার কাছে আবেগ ও শিল্পের মিশেলে সত্য তার রূঢ়তা সহযোগে উঠে আসে। তাই অনেক সময় তাকে আবেগহীনও মনে হতে পারে। তিনি অন্য দুজনের চেয়ে ভিন্ন পারিবারিক আবহ থেকেও উঠে এসেছেন, যেমন ফজলে রাব্বী ভূমিকা অংশে বিষয়টি নিয়ে বলেছেন, তার পরিবার সাহিত্য-সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট নয়, মৃণাল সেনের বাবা ছিলেন একজন আইনজীবী ও কংগ্রেস নেতা। শিল্পের মূলে যদি কোনো কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠিত ধারণার বিপরীত অবস্থান না থাকে তাহলে সেটি শিল্প হতে পারে না, এই কথা বিবেচনয় নিলে মৃণাল সেন তো বাকি দুইজন থেকে বেশি বৈপ্লবিক। তিনি তার পারিবারিক আর্থিক-সাংস্কৃতিক গতিপথকেই অগ্রাহ্য করেছিলেন। এই বৈপ্লবিক অবস্থানে পৌঁছতে তাকে বহু পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। সেসব ফজলে রাব্বীর মৃণাল সেন: জীবন ও সিনেমা বইটিতে আমরা দেখতে পাই। তার শিক্ষাজীবন, যেমন তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষ, ১৯৪০ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতার গিয়েছিলেন। (কিন্তু তাকে বাংলাদেশী মনে হয় না কেন? এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে শুধু তাকে নিয়েই না অন্য যারা কলকাতায় মাইগ্রেট করেছেন তাদের নিয়েও। আমরা ধারণা এর কারণ আর্থসামাজিক ও সাহিত্যিক ভাবধারা, আর পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পার্থক্য বড় ভূমিকা তো রেখেছেই।) সেসময় তিনি বিভিন্ন সমসাময়িক আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তার প্রথম চলচ্চিত্র, “বাইশে শ্রাবণ” “পদাতিক” “ভুবন সোম” “চালচিত্র”সহ উল্লেখযোগ্য, অনুল্লেখযোগ্য সব ছবির নির্মাণই এসেছে। তার প্রেম, আদর্শ, প্রতিবন্ধকতা, উত্থান—ফজলে রাব্বীর ভাষায় “কালানুক্রমিক”ভাবে উঠে এসেছে বইটিতে। মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রকে সম্যক ও গভীরভাবে বুঝতে হলে তার জীবনী জানা প্রয়োজন। ফ্রয়েডিয়ান যে সমালোচনা পদ্ধতি রয়েছে যাতে স্রষ্টাকে জানা ও তার মনোভাবের কারণ জানা প্রযোজনীয় সেই পদ্ধতিটিকে কিন্তু বর্তমান প্রভাব বিস্তারী সাহিত্য সমালোচনার পদ্ধতিগুলো খারিজ করে দিতে পারেনি, বরং তার উপযোগীতা বাড়ছেই। এমনটাই মত তাত্ত্বিক টেরি ঈগলটনের। সেই ক্ষেত্রেও এই বইটি মূল্যবান।

ফজলে রাব্বী মৃণাল সেনের জীবন ও তার কাজকে তুলে এনেছেন যুগপৎভাবে। পাঠকদের জন্যেও উন্মুক্ত করেছেন এই চলচ্চিত্রকারকে। এর সঙ্গে বর্তমানে তাকে নিয়ে যে নতুন কাজগুলো হচ্ছে, তাতেও আলোকপাত করেছেন তিনি। তাও বাড়তি গুণ আরোপ করেছে।

মৃণাল সেন: জীবন ও সিনেমা
লেখক : ফজলে রাব্বী
বিষয়: জীবনীগ্রন্থ
প্রকাশকাল: ২০২৫
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ
দাম: ৩৫০ টাকা। 

বইটি কিনতে চাইলে:

মৃণাল সেন: জীবন ও সিনেমা (Mrinal Sen: Jibon O Cinema) – বাহিরানা


Leave a Comment