অচিনপুর হুমায়ূন আহমেদের লেখক জীবনের প্রথম দিকের উপন্যাস। নন্দিত নরক (১৯৭২) ও শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩)-এর পর অচিনপুর তার তৃতীয় উপন্যাস, প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে।
মধ্যবিত্তের জীবনের চিত্র তার লেখায় তার প্রকরণে প্রবলভাবেই উপস্থাপিত হয়। প্রথম দুইটি উপন্যাসের পর হুমায়ূন আহমেদের অচিনপুর এই জীবনেরই ধারাবাহিকতায় লেখা। আমাদের চারপাশ, চারপাশের মানুষজন সবই যেনো মাঝে মাঝে অচীনপুরের বাসিন্দা হয়ে ওঠে সমাজ, ব্যক্তি মনের পারস্পরিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে। এই বিষয়টি হচ্ছে উপন্যাসটির মূল কেন্দ্র। উপন্যাসের প্রত্যেকটা চরিত্র এরকই রহস্যে ঘেরা। সবারই যেন আলাদা আলাদা চরিত্র আছে, কিন্তু এরই মাঝেই একত্রে বসবাস তাদের। মূল চরিত্র ছাড়াও আবার অনেকগুলো চরিত্র আখ্যানে উপস্থাপিত হয়েছে ছোট পরিসরে, কিন্তু তাদের উপস্থিতি মনে দাগ কেটে যায়।
মানুষের অকস্মাৎ পরিবর্তন বা বিবর্তন যা-ই বলি সেটাকে, তা হুমায়ূন আহমেদের এই উপন্যাসে প্রবলভাবে আছে। যেমন, যাত্রাদল পছন্দ করা রঞ্জুর বাদশা মামা সব ছেড়ে একদিন মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে। এমনই সব বৈপরীত্যে ঘেরা পরিচিত মানুষের অচিন হয়ে উঠা চরিত্রে ঘেরা হুমায়ূন আহমেদের অচিনপুর উপন্যাসে।
রঞ্জু, তার বোন, মা, তার ২ মামা, লাল মামী, বড় নানী, ছোট নানী, সবাই যেনো একই ফুলের আলাদা আলাদা পাপড়ি। সবাই চির পরিচিত আবার মাঝে মাঝে তাদের চরিত্রের আবর্তন এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে মনে হয় তারা অচেনা কোনো জগতের। ফলে উপন্যাসটির মধ্যে একটা দর্শনের দেখা পাই আমরা, সেই দর্শন আবার প্রশ্নের আকারে হাজির হয়। যার উত্তর হুমায়ূন আহমেদ দেন না, আমাদের উপরই উত্তর খোঁজার ভার চাপিয়ে দেন। সেই দর্শনরূপী প্রশ্নটি হলো, আমরা যাদেরকে খুব ভালো করে চিনি-জানি বলে মনে হয়, তারা কী আমাদের এতই জানাবোঝা? যদি তাই হয় তাহলে হঠাৎ হঠাতই তারা এত অপরিচিত হয়ে যায় কেন? কেন মনে হয় যাকে জানতাম, এ কী সে-ই?
যেমন, উপন্যাসের মূল চরিত্র রঞ্জু, মাত্র আট বছর বয়সেই এক সন্ধ্যায় তাকে ভাবিত করে মৃত্যু রহস্য। সেই চিন্তাও সে তার নবু মামাকে বলে, এমন কি সারাদিন যে রঞ্জুর কাটে নবু মামাকে নিয়ে সেই নবু মামাও একদিন অপরিচিত রূপে ধরা দেয় তার বাদশা মামার বিয়ের পর। বিস্মরণও আসে, আমরা দেখতে পাই, চিরহৃদয়ের বড় বোন শাপলার চেহারাও একসময় রঞ্জু ভুলে যায়। রঞ্জুর নানা যাকে সবাই ভয় পায় তিনিও সময়ের সাথে সাথে অপরিচিত রূপে ধরা দেন, তিনি রোজ রঞ্জুর সাথে বাইরে হাঁটতে যান, তার বাড়ি ফিরতে মন চায় না অথচ আগে বহুদিন সে ইচ্ছে পোষণ করলেও, ভয়ে বলা হয় নি কখনও।
মানুষের অকস্মাৎ পরিবর্তন বা বিবর্তন যা-ই বলি সেটাকে, তা হুমায়ূন আহমেদের এই উপন্যাসে প্রবলভাবে আছে। যেমন, যাত্রাদল পছন্দ করা রঞ্জুর বাদশা মামা সব ছেড়ে একদিন মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে। এমনই সব বৈপরীত্যে ঘেরা পরিচিত মানুষের অচিন হয়ে উঠা চরিত্রে ঘেরা হুমায়ূন আহমেদের অচিনপুর উপন্যাসে। আমরা মানুষেরা মানুষেরা আসলে এমনই অচিনপুরে বসবাস করি, মজার কথা হলো উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে আর সমসময়েই ফরাসি তাত্ত্বিক জাক লাকাঁ এই অচিনপুর তত্ত্বের আবিষ্কার করেছিলেন, লাঁকা তার আবিষ্কৃত অচিনপুরের নাম দিয়েছিলেন “রিয়েল”। তত্ত্বটির মতে, আমরা যে বাস্তবতা দেখি তা আসলে ফ্যান্টাসিতে মোড়া। প্রকৃত বাস্তবকে আমরা সহ্য করতে পারি না বলেই একে আমাদের ফ্যান্টাসি দিয়ে মুড়ে দিতে হয়। আর যখন ফ্যান্টাসি কাজ করে না, তখনই আমাদের দেখা বাস্তবাত চিড়ে “রিয়েল” বা হুমায়ূন আহমেদের অচিনপুর প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
অচিনপুরের চরিত্ররাও বাস্তবতাকে (রিয়েল) সহ্য করতে পারে না, তাই তারা ফ্যান্টাসির আশ্রয় নেয়। এদের কেউ কেউ দল বদল করে, কেউ বিস্মরণের আশ্রয় নেয়, কেউবা বদল করে আদর্শের মুখ ও মুখোশ। দুই মহৎ মানুষ, একজন বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক, অন্যজন দুনিয়ার তত্ত্ববিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়া মনোবিজ্ঞানী জাক লাকাঁ—এদের এরকম অচিন যোগাযোগ অবাকই করে। আর তাদেরও আগে আমাদের লালন তার দর্শনে অচিনপুরের কথা বলেছিলেন, “খাঁচারে ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়”। লালনের এই বাক্যে আমরা আত্মাকে খুঁজে পেলেও এর বহুঅর্থবোধকতার প্রতি প্রায়শই নজর দিই না। যে পৃথিবীতে আমাদের চির পরিচিত মুখকে কখনও কখনও অচিনপুরের কেউ মনে হয়, আমাদের কাছে তাদের পরিবর্তন ধরা দেয় সময়ের ঘূর্ণনে। হুমায়ূন আহমেদের গুরুত্বপূর্ণ বই সম্পর্কে জানতে হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ ১০ উপন্যাস আর্টিক্যালটি পড়তে পারেন।
অচিনপুর
লেখক: হুমায়ূন আহমেদ
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ ১৯৭৪
অন্যপ্রকাশ সংস্করণ: ২০২১ (চতুর্থ)
মূল্য: ২০০ টাকা।
