শহীদুল জহিরের ঐ ডলু নদী দেখা যায় গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর সম্পাদিত কথা ছোটকাগজের প্রথম সংখ্যায়, ২০০৪ সালে। ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প বইয়ে যাওয়ার পর গল্পটির যে নাম ডলু নদীর হাওয়া আমরা দেখেছি তার চেয়ে ভিন্ন এই নাম। আরো কয়েকটি শব্দের সঙ্গে মূল নাম থেকে “ঐ” শব্দটিও কেটে দিয়েছেন শহীদুল জহির। এটা টি. এস. এলিয়টের হি ডু দ্য পুলিশ ইন ডিফরেন্ট ভয়েসেস থেকে দ্য ওয়েস্টল্যান্ড-এ পরিবর্তনের মতো নাটকীয় নয়, তবে সুক্ষ্ণ পরিবর্তন অবশ্যই। দেখা দরকার গল্পের নাম শুরুতেই ডলু নদীর হাওয়া দিলেই হতো যেহেতু কিন্তু প্রথমে “ঐ” শব্দটি ছিল কেন? পুরো গল্পটি পড়লে দেখা যায়, এই “ঐ” আসলে অপরের সঙ্গে গাঁট বাঁধতে পারা ও না পারা এবং অপরের সঙ্গে যোগাযোগ অক্ষমতার একটি চিহ্ন, যে শব্দটি পরবর্তীতে শহীদুল জহির কেটে দিয়ে পাঠকদের উপরেই অর্থ বের করার ভার কৌশলে চাপিয়েছেন। কিন্তু প্রথম প্রকাশেও পাঠকদেরই দায়িত্ব ছিল অর্থ বের করার। কেন অপরের সঙ্গে গাঁট বাঁধা যায়, বা যায় না? কেন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে বা আদৌ তৈরিই হয় না? এর কারণ বহু, কিন্তু ঠিক এই গল্পের নিরিখে মোটা দাগে দুইটি কারণ আমাদের দিয়েছেন লেখক, এক, শ্রেণীদ্বন্দ্ব, দুই, শ্রেণীদ্বন্দ্বজাত ঘৃণা। এই লেখাতে আমরা শহীদুল জহিরের ঐ ডলু নদী দেখা যায় গল্পে প্রতিশোধ ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব আহাম্মদ তৈমুর আলি চৌধুরী ও তার স্ত্রী সমর্ত বানুর সম্পর্কে কীভাবে লুকিয়ে ছিল তা খুঁজে দেখব। তাদের মধ্যে প্রেম নাকি প্রতিশোধ চিরঘৃণায় লেপ্টে ছিল—তা খতিয়ে দেখব আমরা শ্রেণিদ্বন্দ্বের আলোকে।
এরপরই আমরা গল্পটিতে শ্রেণিদ্বন্দ্ব দেখতে শুরু করি। যেভাবে মালিকপক্ষ শ্রমিকপক্ষকে ঠকায় সেভাবে মালিক তৈমুর আলি প্রথমে অন্য জায়গায় কাজ দিয়ে সুরত জামালকে সরিয়ে দেয়, আর সমর্ত বানুর বাবাকে নিজের সমিলে ঢুকায়। এরপর কৌশলে জসিম করাতিকে অন্য শহরে রেখে এসে তার বাড়িতে সমর্ত বানুর কাছে যায়। সমর্ত বানু বুঝতে পারে, বাঁচার পথ খোলা নেই। তখন সে এক খেলার আবিষ্কার করে
শহীদুল জহিরকে বাংলায় জাদুবাস্তববাদী ঘরানার একজন সফল কথাসাহিত্যিক মনে করা হয়। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় আমাদের আলোচিত সফল গল্পটিতে জাদুবাস্তবতা একদম নেই, বরং বাস্তবতা আছে রহস্যে, প্রতীকে মোড়া। সেই রহস্য আর প্রতীকও আবার এতই বিষাদময় ও জীবনের চরম সত্য নিয়ে, যে, মনে হয় রূপক আর প্রতীকের বেড়া ডিঙিয়ে সেসব না জানাই ভালো। যেমন কখনও তা জানতে পারেনি গল্পের প্রধান চরিত্র, আহম্মদ তৈমুর আলি চৌধুরী।
গল্পের শুরুতেই ডলু নদী থেকে আসা মানুষের মলের গন্ধমিশ্রিত বাতাসের মধ্যে বারান্দায় আহাম্মদ তৈমুর আলিকে ইজি চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। তার অণ্ডকোষ প্রায়ই উন্মোক্ত থাকে এমন বসে থাকাতে। যা নিয়ে মানুষ মজাও নেয়, তারা তৈমুর আলির সঙ্গে তৈমুর লঙের সাদৃশ্য খুঁজে বের করে। তবে এতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। গল্পের কিছুদূর অগ্রসর হতেই আমরা জানতে পারি তৈমুর আলি ল্যাঙড়া বা খোঁড়া। সে সমাজের বড়লোকগোত্রের, ফলে তার সন্তানরাও প্রতিষ্ঠিত। তার মা গোলেনুর বেগমও ছেলে কেন খোঁড়া হলো সে বিষয়ে প্র্রথমে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেন না, পরে পরিষ্কার হয় তিনি সবই জানেন। তো অব্যবহিত পরেই দেখা যায় শান্ত এক বারান্দার ইজি চেয়ার থেকে উঠেই তৈমুর আলি সমর্ত বানুর সঙ্গে একটি রিচুয়ালে আবদ্ধ হয়, তৈমুর আলিকে বদ্ধ খাবার ঘরে—এখানে সে ও তার স্ত্রী সমর্ত বানু ছাড়া আর কারো থাকার অধিকার নেই—সমর্ত বানুর সঙ্গে একটি খেলায় অংশ নিতে হয়। সৈয়দ শামসুল হকের ভাষায় যাকে বলে “দারুণ বাজিগর” তৈমুর আলি তা-ই। এই খেলায় দুইটি পানিভর্তি গ্লাস থাকে কিন্ত এর একটিতে মারাত্মক বিষ ও অন্যটিতে পানি। আমরা জানতে পারি তৈমুর আলি এতবছর ধরে বাজিগরের মতো খেলায় প্রতিবারই জিতে এসেছে, তবে, তৈমুরের মতো আমাদেরও সন্দেহ হয় আদতে হয়তো দুইটি গ্লাসেই পানি রাখা।
সমর্ত বানুর মা আরকানের মং, নাম অঙমেচিং। তার বাবা বাঙালি জসিমউদ্দিন বা লোকমুখে জইস্স্যা করাতি। মিশ্র জাতির কন্যা সমর্ত বানু। তারও এক আরাকানি মং নাম আছে, এলাচিং। তৈমুর আলিও সমর্ত বানুর সঙ্গে পরিচয়ের ১০ বছর আগে আরাকান ও এর আশেপাশের এলাকায় নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তার বাবার কাঠের ব্যবসা, অর্থবিত্তে সমর্ত বানু ও সে বিপরীত মেরুর। দুই শ্রেণীর। কিন্তু একদিন একটি একাকী শালিক দেখার পর দ্বিতীয় শালিক খুঁজতে গিয়ে সে সমর্ত বানুকে প্রথম দেখতে পায় আর গল্পের কথা মতো তার শেষের সূত্রপাত সেখান থেকেই (কেউ যদি এখানে জাদুবাস্তবতা খুঁজে পান তাতে সাহিত্যিক দোষ নেই)। সে আর তার বন্ধুরা শালিকের পিঁছু নিয়ে নদীর ধারে ১৫ বছরের সমর্ত বানু ও তার চেয়ে বয়সে বড় জসিম করাতির কাঠ চেরাইয়ের সহযোগী সুরত জামালকে একসঙ্গে বসে থাকতে দেখে। মানুষ সুন্দরের মুখোমুখি হলে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইঙ্গিত বুঝতে পারে না, তবে তৈমুর আলি ঠিকই পারে, সে সমর্ত বানুকে ডেকে ছেলেটার বিষয়ে জিজ্ঞেস করে, এবং ভবিষ্যতে এরকমভাবে দু্ইজনের প্রেমিক-প্রেমিকার মতো চলাফেরা করতে নিষেধ করে। কিন্তু তৈমুর আলি একটি বিষয় অনুধাবনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়, যে সুরত জামাল ও সমর্ত বানুর একসঙ্গে বসে থাকা তার ঈর্ষা জাগাচ্ছে। যদি সে সেই ঈর্ষাকে খুঁজে বের করত ও পরিত্যাগ করত তাহলে কী হতে পারত? এটা সে একবারও ভেবে দেখেনি। কারণটাও পরিষ্কার, সে উচ্চশ্রেণীর হওয়ায়, ধরে নিয়েছে, ক্ষমতার কাছে ছোটলোকের প্রেম, ভালোবাসা—যদি থাকেও— সবকিছুই হার মানে। আমরা এখনও ধরে নিচ্ছি, সমর্ত বানু ও সুরত জামালে মধ্যে কোনো প্রেমঘটিত সম্পর্ক নেই, কারণ জহির আমাদের জানাচ্ছেন সুরত জামাল তখনও চেষ্টা তদবির করে যাচ্ছিল সমর্ত বানুর মন পাওয়ার। এরকম ঘটনাচক্র চলাকালীনই একদিন নদীর পাড়ে আবির্ভাব হয় তৈমুর আলির।
এরপরই আমরা গল্পটিতে শ্রেণিদ্বন্দ্ব দেখতে শুরু করি। যেভাবে মালিকপক্ষ শ্রমিকপক্ষকে ঠকায় সেভাবে মালিক তৈমুর আলি প্রথমে অন্য জায়গায় কাজ দিয়ে সুরত জামালকে সরিয়ে দেয়, আর সমর্ত বানুর বাবাকে নিজের সমিলে ঢুকায়। এরপর কৌশলে জসিম করাতিকে অন্য শহরে রেখে এসে তার বাড়িতে সমর্ত বানুর কাছে যায়। সমর্ত বানু বুঝতে পারে, বাঁচার পথ খোলা নেই। তখন সে এক খেলার আবিষ্কার করে, সে তৈমুরকে শর্ত দেয়—এটা হচ্ছে তার প্রথম শর্ত—তার বাড়িতে ঢুকার মুখে খরগোশ ধরার তিনটি সম্ভাব্য ফাঁদ আছে—বাড়ির চারদিকে কাঁটাগাছের বেড়া দিয়ে তিনদিকে সেই সম্ভাব্য ফাঁদ স্থাপন করা—যার একটিতে নিশ্চিত ফাঁদ রয়েছে—যদি তৈমুর আলি ফাঁদহীন রাস্তা দিয়ে ঢুকতে পারে তবেই সে সমর্ত বানুকে পাবে, যদি না পারে তাহলে হার মেনে সমর্তের আশা ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। তৈমুর আলি অনেক হিসাবনিকাশ করেও শেষে ফাঁদযুক্ত রাস্তা দিয়ে ঢুকে, সেদিন সে মরে যেতে পারত, কারণ ফাঁদটা রাখা ছিল মাটির গর্তে, আর সেই গর্তে ছিল অনেকগুলো শক্তসমর্থ চোখা গাছের ডাল। যেগুলোর একটিতে তার গেঁথে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রায় ৮০ ভাগ বা তারও বেশি। কিন্তু সে মরণের ফাঁদে পড়ে না, আর শর্তে হারার রাগক্ষোভে সে সেইরাতে সমর্তবানুকে প্রচণ্ড দলনপীড়ণ করে, সমর্ত বানু সবই মেনে নেয়। তবে পরেরদিন সমর্তের বাড়ি থেকে ফেরার সময় তৈমুর আলি বুঝতে পারে সে ঠিকভাবে হাঁটতে পারছে না, পরে জানা যায় সেই ফাঁদে পড়ার সময় তার বাম পায়ের হাঁটুর চাকতি নড়ে গিয়েছিল, উত্তেজনার বশে সে রাতে সেটি সে বুঝতে পারেনি। এরপর কবিরাজি ও মেডিকেল চিকিৎসার বৈপরীত্যে তাকে আজীবনের জন্য খোঁড়া হওয়া মেনে নিতে হয়।
এরপর আসে দ্বিতীয় শর্ত, পা ভাঙার পর একদিন সমর্ত বানু তৈমুরের বাড়িতে উপস্থিত হয়। কথাবার্তার এক পর্যায়ে সে বলে এখান থেকে বেরিয়েই সে সুরত জামালের সাথে দেখা করতে আলিকদম যাবে। সমর্ত বানু জেনেবুঝেই এই কথা বলে, কারণ যাবার কথা তৈমুরের মনে ঈর্ষার জন্ম দেবে। তা হয়ও, পরেরদিনই সে সমর্ত বানুর বাড়িতে গিয়ে তাকে ডাকতে থাকে, সমর্ত বানু বের হয় না। তৈমুর তাকে বলে সুরত জামালের কাছে তার যাওয়া চলবে না, তৈমুর কিছুতেই তা হতে দেবে না, কারণ সে সমর্তকে বিয়ে করবে। এই শেষ কথাটির পরেই সমর্ত ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে, লেখক আমাদের জানান, সমর্ত একদম প্রস্তুত হয়ে ছিল, কীসের পর কী ঘটবে তা সে জানত। এটা আশ্চর্য যে তৈমুর আলি আরাকান থেকে ফেরার পর শুধু সমর্ত বানুর সঙ্গেই জোর করে শোয়নি, গল্পের প্রথমে আমরা জানতে পারি আরো দুইজন গরীব মেয়ের সঙ্গে সে শুয়েছে। তার বাবার ক্ষমতার কারণে সেগুলো মেয়েদের মায়ের অশ্রুপর্বেই শেষ হয়েছে। কিন্তু সমর্তকে সে বিয়ে করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে যায়। কারণটাও পরিষ্কার, সেই সুরত জামালের বিরুদ্ধে জেতার জন্যে। তখনও আমরা বুঝতে পারি না, সুরত জামালের সঙ্গে সমর্ত বানুর হৃদয়ঘটনা কতদূর গড়িয়েছিল। তৈমুরও জানে না। শুধু ঈর্ষা আর জয়ের বাসনা তাকে পাগল করে তুলে।
তখনই ঘর থেকে বেরিয়েই সমর্ত বানু তাকে দ্বিতীয় ও শেষ শর্তটি দেয়। শর্তটি হলো, বাসর রাত থেকেই সমর্ত বানু তৈমুরকে দুই গ্লাস পানি দেবে, এর মধ্যে একটায় থাকবে বিষ, আরেকটায় পানি। গ্লাস বাছতে ভুল হলেই মৃত্যু নিশ্চিত। তৈমুর এটাকেও এক খেলা হিসেবে ধরে নেয়, ফলে মেনে নেয়। ভাবে সমর্ত বানু বিষ দেবে না, মজা করছে। কিন্তু সমর্ত বানু যে সত্যি সত্যিই বলেছিল, তার প্রমাণ দেয় বাসর রাতেই, পাশের বাড়ি থেকে সেইদিন দুইটা বেড়াল আনতে হয়, বেড়ালগুলোকে দুই বাটিতে খাবার দেয় সমর্ত বানু, এক বাটিতে বিষ মেশানো খাবার আরেকটিতে বিষ ছাড়া। খাবার পরেই হঠাত একটি বেড়াল ছটফট করতে করতে মরে যায়, আরেকটির কিছুই হয় না।
এই বিষেরও আরেকটি গল্প আছে, সমর্ত বানুর মা অঙমেচিং পোটকা মাছ খেয়ে মারা গিয়েছিলেন, সেদিন তাদের তিনজনই এই মাছ খেয়েছিল, কিন্তু মারা গিয়েছিলেন শুধু অঙমেচিং। তো, মরণের আগে অঙমেচিং তার মেয়েকে একটি আংটি দিয়ে যান, বলেন যে, এই আংটির মধ্যে থাকা পাথরটি আসলে হীরা, এটা অঙমেচিংয়ের বাবা খনিতে কাজ করতে গিয়ে পেয়েছিলেন। তো সেই থেকে এই আংটি সমর্ত বানুর আঙুলে রয়েছে, বিয়ের পর তৈমুর অনেক চেষ্টা করেছে আংটিটি খোলার, কিন্তু পারেনি। কারণ সেটি বহুবছর ধরে সমর্ত বানুর আঙুলে চেপে থাকতে থাকতে তার আঙুলের অংশ হয়ে গেছে। খোলা অসম্ভব যদি আঙুল না কাটা হয়। তো, এই বাসর রাতের পর থেকে প্রতিদিনই শর্ত মেনে তৈমুর আলিকে দুই গ্লাসের খেলায় অংশ নিতে হয়। আপনাদের নিশ্চয়ই রজকিনীর জন্য পানিতে ছিপ ফেলে চণ্ডীদাসের বসে থাকার ঘটনা মনে আছে? এ যেন সেই ঘটনা।
তো সবকিছুরই শেষ আছে, ক্লান্তি আছে, সব প্রেম, সব ঘৃণা ক্ষয়ে যায়। আমরা দেখি, একদিন তৈমুর আলি তার মনে এতবছর ধরে যে ধারণা ছিল, যে হয়তো দুই গ্লাসেই পানি, নাহলে এতবছর ধরে তার কিছু হলো না কেন? এই ভাবনা ও সন্দেহকে সিদ্ধান্তে পরিণত করে। খাবার দেওয়ার পর সমর্ত বানু একটানা দাঁড়িয়ে থাকে তৈমুর আলির খাওয়া শেষ হওয়ার জন্য, শেষ হলে সে দুই হাতে গ্লাস এগিয়ে দেয়, এরমধ্যে একটাকে বেছে নেয় তৈমুর। চল্লিশ বছর ধরে তৈমুর আলি খেলায় প্রতিবারই জিতে আসছে, তাই সেদিন তার সন্দেহ বিশ্বাসে রূপ নেয়, যে কোথাও “জারিজুরি” আছে, সমর্ত তখন চিনি আনতে ঘরের বাইরে গিয়েছিল, এই সময় সে দুই গ্লাস পানিই একটার পর একটা খেয়ে নেয়। এরপর যা ঘটে তা হলো, তৈমুর আলি বিছানায় এলিয়ে পড়ে, এলাচিং ফিরে এসে তাকে দেখেই বুঝতে পারে কী হয়েছে, সে ডাক্তার ডাকতে বলে বাড়ির অন্যদের। কিন্তু ডাক্তার দেখে বলে হার্ট অ্যাটাক, আরো আগেই তৈমুর আলি মারা গেছে। মানে পানি খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মরণ হয়েছিল তার। চণ্ডীদাস অবশেষে তার রজকিনীর দেখা পেল।
এরপর আমরা দেখতে পাই আরেক ধাঁধা, স্বামীর মৃত্যুর চল্লিশদিন পর সমর্ত বানু তার ছোট ছেলে মিরাজ আলিকে বলে, “আঁই আলিখদম যাইয়েরে থাইক্কুম, আঁরে আলিখদমত রাকি আইস্যু।” তার কথামতোই সব করা হয়। আলিকদম যাওয়ার আগে সে তার ছোট ছেলেকে—যে আংটি শতচেষ্টা সত্ত্বেও তৈমুর আলি খুলতে পারেনি, বার্ধক্যে এখন সেই আঙুল শুকিয়ে গেছে, তাই সহজেই খুলে যায়—তার আংটি দিয়ে যায়, বলে “রাখি দঅও, ইবা হিরা”। এই বলে সে সাতকানিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে আলিকদমের দিকে যাত্রা করে।
কিন্তু এই জায়গা থেকেই সবকিছু পাল্টে যেতে শুরু করে, পুরো গল্পটিই পাঠকের মনে আবার প্রথম থেকে শুরু হয়। কারণ মিরাজ আলি এক জুয়েলারি দোকানে অভিজ্ঞ একজনকে দিয়ে তার আংটি পরখ করায়। তখন সে জানতে পারে আংটিতে হীরা নেই, আছে পাথর। মিরাজ আলি মায়ের প্রতি মমত্ববোধে আংটিটি যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দেয়।
এখন আমাদের মূল বিষয়টিতে আসা যাক, সমর্ত বানু আসলে কাকে ভালোবাসতো? তৈমুর আলি নাকি সুরত জামালকে? সে নিজের স্বামীর স্মৃতি ফেলে আলিকদম কেন গেল? আলিকদমেই তো সুরত জামালকে সমর্ত বানুর কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য তৈমুর আলি কায়দা করে পাঠিয়েছিল। তখন জট খুলতে শুরু করে, আসলে শুরু থেকেই একটা বড় অবিচার হয়ে গেছে সমর্ত বানুর সাথে। ঐ ডলু নদী দেখা যায় আসলে এক অবিশ্বাস আর অবিচারের গল্প। শ্রেণিদ্বন্দ্বের গল্প। তৈমুরের মা আমাদের কথায় সায় দেন, তিনি বলেন, “কোয়লত বাজি! কিন্তু তারপর সে বলে যে, সবকিছুই ছিল সমর্ত বানুর পাতা ফান্দ, একটা মগের মেয়ে কেমন করে গ্রামের সবচাইত সমর্থ এবং উপযুক্ত পুরুষটাকে ধরে এটা ছিল তার একটা নমুনা;” (ঐ ডলু নদী দেখা যায়), তার মানে, তৈমুর আলিদের উচ্চশ্রেণীর পক্ষ থেকে বিষয়টিকে দেখলে, সব দোষ এলাচিংয়ের, কারণ তৈমুরকে বিয়ে করার তার কোনো যোগ্যতাই নেই, একে তো, সে, জইস্স্যা করাতির মেয়ে, তার উপর তার মা হচ্ছে ভিন দেশের মগ। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, এখানে পুঁজিপতি তৈমুর আলি শ্রমিক শ্রেণীর এলাচিংকে ফাঁদে ফেলেছে। সে পয়সার জোরে তার বাবাকে নিজের সমিলে কাজ দিয়ে অন্য এক শহরে ছল করে রেখে এসেছে। এলাচিংয়ের সাথে সুরত জামালের প্রায় হয়ে যাওয়া প্রেমের প্রতি ঈর্ষায় সে সুরত জামালকে অন্য এক গ্রামে কাজ দিয়ে পাঠিয়েছে। এত এত ফাঁদের পর সে এলাচিংকে অধিকার করেছে। এলাচিং যদি খরগোশ ধরার ফাঁদ পেতে তাকে খোঁড়া করেছে, তো সে ফাঁদ পেতেছে তিনজন মানুষের জীবনে—এলাচিং, বাবা জসিম করাতি ও সুরত জামাল। এই কারণেই শহীদুল জহির কৌশলে এলাচিংকে দিয়ে তিনটি ফাঁদ পাতিয়েছিলেন সেই রাতে। ফাঁদগুলো মূলে তাদের বাস্তব জীবনের প্রতীক।
এখন ঘটনা পূর্ণতা পায় যদি আমরা জানতে পারি সুরত জামালের সঙ্গে এলাচিংয়ের প্রায় প্রেম নাকি সম্পূর্ণ প্রেম ছিল। যদি তাই হয় তাহলে এটা প্রকৃতই এক প্রতিশোধের আখ্যান হয়ে ওঠে। আমাদের মত হচ্ছে সুরত জামালের সঙ্গে এলাচিংয়ের গভীর প্রেম ছিল। কিন্তু ক্ষমতার কাছে সেই প্রেম পূর্ণতা পায়নি। তাদের দুজন কখনওই তাদের প্রেমের কথা সমাজের সামনে আনতে পারেনি। সুযোগই পায়নি। আমাদের যুক্তির সত্যতার পক্ষে রায় দিচ্ছে স্বয়ং গল্পটিই, এর জন্য আমাদেরকে প্রথম শর্তের কাছে ফিরে যেতে হবে, খরগোশ ধরার ফাঁদে অনেকগুলো চোখা গাছের ডাল রেখেছিল কেন সমর্ত বানু? তৈমুর আলির পা খোঁড়া হলো কেন শুধু? আসলে সেটা খরগোশ ধরার ফাঁদ ছিলই না, ছিল মৃত্যুফাঁদ। এইকারণেই তৈমুর আলি যখন ফাঁদ থেকে উঠে সমর্তের ঘরে যায় সমর্ত বানু তৈমুরের শর্ত ভঙ্গের জন্য তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে না। কেননা তা হলে মৃত্যুফাঁদের বিষয়টি নিয়ে তৈমুরের সন্দেহ তৈরি হবে, আর এতে ক্ষতি বহুগুণ বাড়বে। তাই সে আগেই ঠিক করে রেখেছিল, যদি তৈমুর আলি ফাঁদ থেকে বেঁচে ফেরে তাহলে তার অন্য পথ খোলা নেই। একারণেই পরবর্তীতে সে সুরত জামালের প্রসঙ্গ তুলে তৈমুরের ঈর্ষা জাগানোর জন্য।
কিন্তু কী হতো যদি তৈমুর আলি একরাত্রির ভোগেই তৃপ্ত হয়ে যেত? যেটা সে আগেও অনেকবার হয়েছে? তাহলে সমর্ত বানু যে আলিকদম যাওয়ার কথা বলেছিল, সে সেখানেই যেত, সুরত জামালের কাছে। মূল কথা হলো, সমর্ত বানু দ্বৈত অর্থের প্রয়োগ করেছিল সেদিন, যদি সে সুরত জামালে কাছে বিনা বাধায় যেতে পারে তাহলে তৈমুর আলি মুক্ত। আর যদি তৈমুর আলি ঈর্ষার ফাঁদে পড়ে তাহলে তাকে সত্যি সত্যিই একদিন মরতে হবে। এই কারণেই দ্বিতীয় শর্তের উদ্ভব। আমরা দেখতে পাই দ্বিতীয় শর্ত সে আলিকদম যাওযার কথা বলার পরেরদিন বলে। তার মানে সে এই শর্তটি অনেক ভেবেচিন্তে তৈরি করেছে ওইদিন রাতে।
সে দেখেছে, তৈমুরের কাছ থেকে বাঁচার একটাই পথ খোলা আছে, তা হলো তাকে হত্যা করা। আর এরজন্য সে সময় নিয়েছে চল্লিশ বছর! কয়েকটি সন্তান ও তাদের সন্তানও জন্ম নিয়ে নিয়েছে ততবছরে! কত গভীর অপরাধ তার সাথে সংঘটিত হয়েছিল আর তার ফলে তার প্রতিশোধের আগুন কত বাড়ন্ত ছিল এই সময় ও তার ধৈর্যের ঘটনাটিতেই তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা উপন্যাসের সাথে তাই গল্পটির মিল পাওয়া যায়। এই অপেক্ষাপর্ব উপন্যাসটির নায়কের ভাগ্যেও ছিল। ফ্লোরেন্তিনো আরিজারও অপরাধ ছিল তার বিত্তের অভাব।
শেষ করার আগে একটি রহস্যে নিষ্পত্তি এখনও বাকি, আংটিতে কী আসলেই বিষ ছিল? পুরো ঘটনা বিশ্লেষণের পর এখন আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, আসলে আংটিতে বিষ ছিল না। কিন্তু বেড়াল মারার সময় সমর্ত বানু ঠিকই সত্যিকারের বিষ মিশিয়েছিল। তৈমুরের মৃত্যু ঠিক এই কারণেই হয়েছিল, সমর্ত বানু অশিক্ষিত ও ছোটলোকের মেয়ে ছিল ঠিকই কিন্তু খুবই বুদ্ধিমান ছিল, তার মায়ের কাছ থেকেই সে এই বুদ্ধি পেয়েছিল। তার মা দুইটি দেশ দুইটি জাতি দেখেছেন, সেই অভিজ্ঞতা তিনি চেতন-অবচেতনে তার মেয়েকেও দিয়ে গিয়েছেন। বুদ্ধিটা হলো, মনোবিজ্ঞান বলে, আমাদের মস্তিষ্ক আমরা যে জিনিস যত গভীরভাবে নিজেদের মনে বলি তা-ই সত্য বলে ধরে নেয়। সমর্ত বানু ঠিক এই কাজটিই করেছে, কাজে ও কথায়। প্রথমে বেড়াল মেরে সে প্রমাণ করতে চেয়েছে তার আংটিতে বিষ আছে, এরপর সেই শর্ত অনুযায়ী প্রতিদিন তার হাত থেকে গ্লাস বেছে পানি খাওয়ার খেলা। ফলে, তৈমুরের সন্দেহের উর্ধ্বে তার মস্তিষ্ক অত বছরের লাগাতার পুনরাবৃত্তিতে সমর্ত বানুর কথাটিকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছে। এটি তৈমুর আলি জানত না, জানত সমর্ত বানু। সে শুরু থেকেই জানত তৈমুর আলির মস্তিষ্ক বিষের কথাটি সত্য বলে মেনে নেবে কিন্তু বিপরীতে তৈমুর আলির সন্দেহও একদিন জয়ী হবে। আদতে তাই হয়েছে, তৈমুর আলি শর্ত ভেঙেছে, কিন্তু মস্তিষ্ক বিষের কথা সত্য মেনে সত্যিকারের বিষের অনুরূপ ক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল। ফলাফল মৃত্যু। এরপর পড়ে রইল সেই সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীরতর এক ভালোবাসাপূর্ণ জীবন যেখানে চল্লিশ বছর পর সমর্ত বানু আর সুরত জামালের মিলন হয়।
তখন তৈমুর আলির ভালোবাসা না পাওয়া ব্যর্থ জীবন কী কিছুটা দুঃখ ও বিষণ্নতাও জাগায় না আমাদের মনে? শত দোষ সত্ত্বেও তৈমুর আলি ভালোবাসারই কাঙাল ছিল আজীবন, যা সে একটিবারের জন্যে পায়নি। এবং যার কাছে সে ভালোবাসা চেয়েছিল তার হাতেই ৪০ বছর যাবত ক্রমে ক্রমে সে মৃত্যুবরণ করেছে। এরচেয়ে করুণ কিছু হতে পারে না একজন মানুষের জীবনে। কিছু সত্য মৃত্যুর চেয়েও কঠোর, পাষাণ—এই ভাবনা থেকেই বোধহয় শহীদুল জহির তৈমুর আলিকে প্রকৃত ঘটনাটি জানাতে চাননি, আমাদের কাছে উন্মোচন করেছেন। শহিদুল জহিরের ঐ ডলু নদী দেখা যায় শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, বিশ্বসাহিত্যেও এরকম প্রতিশোধ, বেদনা, রহস্য আর অপেক্ষা, প্রেম-অপ্রেমের বিবরণ নিয়ে বিরল।
শহীদুল জহির তার কথাসাহিত্যের মাধ্যমে তার পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকদের কাছেও পৌঁছাতে পেরেছেন সফলভাবে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শেখ লুৎফর বাহিরানা Talk-এ তার প্রিয় সাহিত্যিকদের তালিকায় শহীদুল জহিরের উল্লেখ করেছেন। আরেকজন কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হক তার সাক্ষাৎকারে বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় এই খ্যাতিমান লেখকের নাম নিয়েছেন।
